গ্রন্থ সমালোচনা: চিরসখা — নবকুমার বসু
এক প্রিয় বন্ধুর অনুরোধে শেষ করলাম ৯৮২ পাতার দীর্ঘ উপন্যাস “চিরসখা”।
এ এক অদ্ভুত পরিবারের ইতিবৃত্ত। বলা যায় এক দীর্ঘ পারিবারিক ইতিহাস যা বাস্তবের
অনুসারী। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, ভেঙে পড়া এক সংসারে এমনটাই তো
হয় অথবা হতে পারে। উপন্যাসের শুরুর অংশে কেন্দ্রবিন্দু থেকেছেন অপর্ণা, বিখ্যাত লেখক বিভাস চৌধুরীর স্ত্রী। একবস্ত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে বাউন্ডুলে
লেখকের সাথে আতপুরের এক খুপরি চালায় ঘর বেঁধেছিলো সে। কত স্বপ্ন তখন তাদের দু-জোড়া চোখে। সেই স্বপ্নের ভালোবাসায় জন্মায় তাদের চার সন্তান বুনু, ঝুনু, বুজু আর টুলি। চরম দারিদ্রের ছায়ায় প্রত্যন্ত
গ্রামের কোলে একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে তারা। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয় ধীরে
ধীরে। বিভাস লেখক হিসাবে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পান, আনন্দ
গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হন, পরিবারে আসে আর্থিক সচ্ছলতা। এমনটা
চললেই হয়তো ঠিক হতো। সংগ্রাম আর সাফল্যের প্রেরণায় এগিয়ে যেত অপর্ণা-বিভাসের
প্রেমের গল্প। কিন্তু তা হয়নি।
বিভাসের জীবনে ঝড়ের মতো অকস্মাৎ এসে দাঁড়ায় ইতু, অপর্ণার সব থেকে ছোট বোন। এই অনৈতিক প্রেমের পালে হাওয়া জোগায় অপর্ণার মা আর দাদারা। তাদের কিছু স্বার্থসম্বন্ধও ছিল তাতে। বিভাসের জেষ্ঠা কন্যা বুনু আর এই শ্যালিকা ইতু একেবারেই সমবয়সী। হঠাৎ দুমড়ে মুচড়ে যায় সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাওয়া স্বামী-স্ত্রী আর চার ছেলেমেয়ের সাধের ঘর। কাহিনী অনুযায়ী ইতু অশিক্ষিতা, বুদ্ধিহীনা এক মেয়ে, যার সম্বল শুধু এক উগ্র শরীর। সেই মোহিনী জালে আটকে পড়েন মানুষের মনের কারবারি লেখক বিভাস। ধর্মপত্নীকে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখে সেই শরীরিণীকে নিয়ে নতুন বাসা বাঁধেন কলকাতায়। ইতুকে বিয়ে করেন, কি করেননি তা উল্লিখিত হয়নি। অপর্ণা ছেলেমেয়েদের নিয়ে থেকে যায় তাদের নতুন আবাস নৈহাটির বসতবাটিতে। গল্পের মোড় ঘোরে অন্য পথে। শুরু হয় কুৎসা, অবিশ্বাস, তীব্র টানাপোড়েন আর তার সাথে অপর্ণাকে মহিয়সী রূপে দেখানোর প্রয়াস। আশ্চর্যজনকভাবে বিভাস চৌধুরীও থেকে যান আর এক মহান মানুষ হয়ে। অবৈধভাবে একটি নারীর সাথে রাত্রিবাসে তার এতটুকু চরিত্রস্খলন হয় না। কারণ, তিনি সৃষ্টির রসে বিভোর। বড়ো মেয়ের সন্তান, তাঁর আপন নাতি আর দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে একবয়সের হলেও ইতু জানায় সেই বয়সেও বিভাস শরীরের খেলায় অনাগ্রহী নন। যখন ইতুর পছন্দের আদিরসাত্মক মন্তব্য চলেছে অকাতরে, তার রসগ্রহনের দায়িত্ব পড়েছে পাঠকের উপরে। বিভাস থেকেছেন নির্বিকার, তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েদের কাছে দায়িত্বশীল পিতা হিসেবে। কারণটি অবশ্য বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হয়না — অপর্ণাকে ছেড়ে এলেও আর্থিকভাবে পরিবারটি সবসময় নির্ভর করেছে বিভাসের উপর। তার সাথে নামী পিতার সন্তান হবার গরিমা তো আছেই। তবে ছেলেমেয়েদের পরিণত বয়সেও এই আর্থিক নির্ভরশীলতা কমেনি। কাজেই পরনারী ক্রীড়ায় মশগুল পিতাকে গ্রহণ করতেও মন থেকে কোনো বাধা আসেনি। শুধু ইতু থেকেছে প্রথম পক্ষের সকলের চক্ষুশূল হয়ে। যে অবৈধ কাজটি বিভাস করেছেন তাঁর মধ্য যৌবনে, তার মাশুল গুণতে হয়েছে ইতুকে, গোটা উপন্যাস জুড়ে। শরীরের অধিকার ছেড়েও অপর্ণা যে ভালোবাসায় বিভাসকে নিজের বলে ভেবেছে, সেই কর্তব্য থেকে ইতুকেও সতীন বলে মেনে নিতে দ্বিধা বোধ করেনি। স্বামীরূপী এই পুরুষটির অসামাজিক আচরণ আর পরস্ত্রী গ্রহণ তার কাছে সমস্যা হয়ে ওঠেনি। বিষয়টি সম্পূর্ণ আর্থিক হলেও হতে পারে, যদি না ভালোবাসা অপর্ণাকে অনর্থক অন্ধ করে রাখে। সমাজের চোখে নিজেকে সর্বংসহা করে তোলার আরেক তাগিদও থাকতে পারে।
উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তিত হয়েছে মধ্যভাগ থেকে। তখন অপর্ণা নয়, গল্পের গতির শিরোনামে এসেছে তার মেজছেলে বুজু। সে ভালো ছাত্র, বিলেত ফেরত ডাক্তার। সৌভাগ্যক্রমে তার সবই উপযুক্ত — সুশীলা বৌ স্বাতীও ডাক্তার। স্বাতীর বাবা হৃদয়বান, মা স্নেহময়ী, দিদিরাও প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার এবং বুজুর চক্ষে এরা অফুরন্ত ভালো। আসলে বুজুর চোখে আশেপাশের বাকি সবাই খারাপ, অথবা ভাগ্যের বলি। তার দিদি বুনুর স্বামীভাগ্য করুণ — সেই লোকটি মদ্যপ এবং বুনু আর তার ছেলের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যহীন নির্দয়। বুনু শান্তিনিকেতনে সংগীত ভবনের ছাত্রী এবং পরে শিক্ষিকা। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে ছেলেকে নিয়ে একাই থাকতো এক ভাড়াবাড়িতে। কিন্তু সেখানে সংগীত ভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুযোগ বুঝে লোভ মেটাতে একদিন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। বুনুর প্রেমিক তমাল আবেগের রাশ ধরতে না পেরে আত্মহনন করে বসে। বুনুর পরের ভাই ঝুনুর পরিবারটিও সুবিধালোভী। প্রকাশক হবার সুবাদে ঝুনুও নানান উপায়ে বিখ্যাত লেখক বাবার প্রাপ্য অর্থ হস্তগত করে রাখে। নানান কিছুতে বাবার থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। ঝুনুর স্ত্রী টুশুর বাপ-মাও বুজুর দৃষ্টিতে যথেষ্ট নিচ এবং বিভাস চৌধুরীর এই কৃতি পরিবারটির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। শাশুড়ি অপর্ণার সাথেও টুশুর খিটিমিটি চলতে থাকে। শুধু ভালো বৌ হবার দায়িত্ব ধরে রাখে বুজুর ডাক্তার স্ত্রী স্বাতী। এই ভাইবোনেদের সবার ছোট বোন টুলির বিয়ে হয় সাদামাটা এক ছাপোষা ব্যক্তির সাথে। কাজেই বিভাস চৌধুরীর ওপর নির্ভরতায় কেউই পিছিয়ে থাকে না। টুলির বিয়ের আগেই অবহেলার আঘাত আর ইতুর উপস্থিতিতে ক্ষয় হতে হতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে অপর্ণা। সেখানেও তার দেখভালের সবথেকে বেশি দায়িত্ব নেয় ডাক্তার পুত্র বুজু; তার উপরে লেখকের বড়ো আস্থা। বাকিরা নিজেদের জীবনসংগ্রাম বা আখের গোছাতেই মনোযোগী থাকে। অপর্ণার মৃত্যুতেও এই অদ্ভুত পরিবারে কিছু দুঃখের অনুভূতি স্থায়ী হয়নি। অপর্ণা মদ্যপান চূড়ান্ত অপছন্দ করলেও বিভাস আর ছেলেদের একসাথে বসে যত্রতত্র মদ্যপানের মাত্রা বেড়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছে জামাইরাও। কখনোসখনো মেয়েরাও। অপর্ণা এবং ইতুর বাপের বাড়ির গল্প তো কেচ্ছার এক আকর। অপর্ণার এক ভাইয়ের স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসে অন্য ভাইয়ের আরামের অভ্যাসে। আর এক ভাই তো সন্তান উৎপাদনে অক্ষম বলে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্য সুখের বাসায় ডানা মেলে চলে যায়। সবটুকুই অবশ্য চলেছে অনুমানের ভিত্তিতে। তবু কেচ্ছাকাহিনী বলে উপন্যাস তাকে সত্যের মর্যাদা দিয়েছে। ঝুনু বুজুর এক মামার কিশোরী মেয়ে ফুলির শরীরের যে চটুল বর্ণনা রয়েছে, তা কদর্যতার সামিল। বিভাসের বৃদ্ধ জীবনেও এসে হাজির হয়েছে নতুন পত্রিকা নাগরিকের কর্মী যুবতী ইশিতা। আশ্চর্যের ব্যাপার সেও প্রতিভাবান বিভাসকে শরীরের দানে উজ্জীবিত রেখেছে। চার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে সব জেনেবুঝেও শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় বিখ্যাত বাবাকে মাথার উপরে রেখে দিয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রী এবং মাসি ইতু যখন এই নতুন পাখি ইশিতাকে সরাতে উদ্যত হয়, ছেলেমেয়েদের বিশেষ তাপোত্তাপ বোঝা যায়নি। ভাবটা এমন, হতে দাও না। বাবা যে সৃষ্টির রসে উন্মুখ। এমন দু-একটা যৌবনবতী সাথে থাকলে তাঁর লেখার মান পড়ে যাবে না।
উপন্যাসের “চিরসখা” নামের উদ্দেশ্য হয়তো বিভাসের প্রতি অপর্ণার চিরকালের প্রেম। কিন্তু বিভাসের দিক থেকে তার তেমন কিছু
প্রতিদান বোঝা যায়নি, শুধু কিছু কর্তব্যপালন ছাড়া। ইতু হলো
বিভাসের শরীরসুখের মূর্ত প্রতীক। কাহিনী সূত্রে ইতু আর বিভাসের একমাত্র ছেলে রনি আর
অন্য চার ভাইবোনেদের ছেলেমেয়েরাও এসেছে। কিন্তু তাদের কথা তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
ওঠেনি। শান্তিনিকেতনের ভাস্কর তীর্থঙ্করকে নিয়ে বিভাস উপন্যাস রচনার চেষ্টা করছেন, তা নানান প্রসঙ্গে এসেছে। কিন্তু কুৎসা আর নিন্দা-অপবাদের স্রোতে সে প্রচেষ্টার
সম্পূর্ণ রূপটুকু দেখা যায়নি। পাঠভবনের ছাত্র রনি আর মেয়ে বুনুকে
দেখতে সঙ্গিনী ইতুকে নিয়ে বিভাস মাঝেমধ্যেই শান্তিনিকেতনে এসেছেন। তীর্থঙ্করের
জীবন আর কাজের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন, কিন্তু জানা হয়নি
সে উপন্যাস আদৌ লেখা হয়েছে কিনা। লেখার ধারাটি এতটাই বাস্তবানুগ যে পড়তে পড়তে মনে
হয় এই চরিত্রদের পিছনে সত্যিকারের কেউ লুকিয়ে নেই তো? যদি
সত্যিই সেই চরিত্ররা কোথাও থাকেন, তবে এই কাহিনী তাদের জন্য
লজ্জার, অপমানের আর হয়তো বা কিছুটা দুঃখেরও।
....................
চিরসখা
লেখক: নবকুমার বসু
আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম সংস্করণ: ২০০৫
Comments
Post a Comment