মাধ্যমিকের পঁচিশ বছর: ১৯৯৫—২০২০

আমার মাধ্যমিকের পর পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে, তো কি এমন হয়েছে? প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে দশ ক্লাসের গণ্ডি পার করে পরবর্তী জীবনে পা রাখছে। এ তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমার জীবনেও একদিন তা হয়েছে। কিন্তু সেকথা বিশেষ করে লেখার কি আছে? তা বলবো বলেই তো এই লেখার সূচনা। ১৯৯৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই পঁচিশ বছরে আমাদের সামাজিক ও বৌদ্ধিক জীবনের এক বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। যে মফস্বল শহরটিতে আমি কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছি, আজ তা কালের স্রোতে বড্ডো বেশি রকমের আধুনিক হয়ে গেছে। কর্মস্থান দিল্লী থেকে প্রতি বছর ঘরের টানে যখন সেখানে ফিরে যাই, দেখি যে সেই কিশোরবেলার রূপ বহুতর পাল্টে গেছে। যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, আমরা আমাদের যৌথ পরিবারে মাটিতে বসে পাত পেরে খেতাম। সকালে ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে ৫০ পয়সার টিকিট কেটে বাসে চড়ে ইস্কুলে যেতাম। বিকেলে বাড়ি ফিরে আবার একপ্রস্থ ভাত ডাল। সেদিন আমাদের জীবনে মোবাইল তো দূরাগত, কোনো ধরনের ফোন যোগাযোগের স্পর্শ ছিল না বাড়িতে। কম্পিউটার নামক যন্ত্রের নাম ছিল অশ্রুত, না ছিল ইমেইল অথবা অন্য কোনো প্রযুক্তির সংযোগ। কারোর খবর জানতে হলে তার বাড়িতে যেতে হতো। মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পর আমার পাশের খবর অনেককে জানিয়েছিলাম চিঠি লিখে। আজ মনে হবে পরীক্ষায় পাশের কথা অত বলার কি আছে? কিন্তু যেকালের কথা লিখতে বসেছি, সেকালে এই মাধ্যমিকের ফলের খবর পাড়ায় পাড়ায় জানা যেতো। এলাকার মানুষরা জানতো এই বছর কোন কোন ছেলেমেয়ে এই পরীক্ষায় বসতে চলেছে। কে কেমন নম্বর পেয়েছে। কে কোথায় কি নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, এই সব। এমনকি কে কার কাছে প্রাইভেট কোচিং নিতো, সেসবও। কারণ, এই মাধ্যমিক পরীক্ষা তখন ছিল বড়ো হওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আজ সেকথা ভুল মনে হলেও তখন অন্ততঃ তেমনটাই মনে করা হতো।

ছবি ১: বালি শান্তিরাম বিদ্যালয়
দশম শ্রেণীর এই ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম বালির একটি বহু পুরনো ইস্কুলের ছাত্র হিসাবে, নাম বালি শান্তিরাম বিদ্যালয়। স্থানীয় এক ভূস্বামী ছিলেন শান্তিরাম রাজা, তাঁরই নামে ইস্কুলের নাম। শতবর্ষ পেরোনো এই বিদ্যালয়ের পুরনো নাম ছিল রিভার থম্পসন স্কুল। জাতীয়করণের ফলশ্রুতিতে ওই নতুন নাম। হাওড়া জেলার বালি অঞ্চলের যে পাড়ায় আমাদের বাড়ি, তার নাম শান্তিরাম রাস্তা। আমাদের বাড়ির কাছেই একসময় ছিল সেই ভূস্বামী শান্তিরাম রাজার বাস্তুভিটা। সময়ের প্রভাবে আজ সেই ভিটা অবশ্য বিলুপ্ত। শতবর্ষ পেরোনো ইস্কুল হলে কি হবে, আসলে বালি শান্তিরাম ছিল আমাদের সময়ে ওই অঞ্চলের সবথেকে কুখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, ওই অঞ্চলের সব থেকে ফেল মারা ছাত্রদের স্থান হতো এই বিদ্যালয়টিতে। দশম শ্রেণীতে প্রথম যেদিন এই ইস্কুলে ক্লাস করতে যাই, দেখি আমার থেকে বয়সে বেশ বড়ো কিছু ছেলে বসে আছে ক্লাসে। তাদের মুখ গোঁফদাড়িতে আচ্ছন্ন। আমাদের মুখে শুধু বয়ঃসন্ধির আগমনের আভাস। ওখানকার অপেক্ষাকৃত কমবয়সি ছাত্রদের মুখে শুনলাম, এই বড়ো ছেলেদের বলা হয় কাকু। ইস্কুলের বেশ পুরনো পড়ুয়া তারা। দোতলার একেবারে বাঁদিকের যে ঘরটিতে ক্লাস হয়েছিলো, তার কোনো জানলার গরাদ নেই। শুনলাম, ক্লাস করতে অপছন্দ হলে অনায়াসে সেই জানলা দিয়ে নিচে নেমে যাওয়া যায়। ইস্কুলের কোনো গেটও নেই, আর দারোয়ান তো দূরঅস্ত। তাই সময় অসময়ে বাড়ি থেকে একপাক ঘুরে আসলে বলারও কেউ নেই। অর্থাৎ কিনা পূর্ণ স্বাধীনতা এই বিদ্যালয়ের অঙ্গে অঙ্গে। ইস্কুলের পাশেই গঙ্গা, আর তার সামনেই খেলার মাঠ। দৈর্ঘ্যে ছোট, বহরে বড়ো হেডমাষ্টার মশাইকে দেখেও বিশেষ শ্রদ্ধা জাগেনি। শুনলাম, ছাত্রদের সাথে বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না তিনি। হাতের ছোট লাঠিটি দিয়েই যাবতীয় কাজ সারেন। প্রথম দিনের ক্লাস নিয়েছিলেন ভুগোলের স্যার লক্ষ্মী বাবু। তার নোংরা ধুতি পাঞ্জাবি, আর তেল চিটচিটে ব্যাগ মনে যে ভাব তরঙ্গ তৈরি করলো, তার থেকে টেনে নিলেন তিনি নিজেই। আমার সাথে কথা বলে আমাকে ওনার বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। জানালেন আমাদের বাড়ির কাছেই সরখেল পাড়াতে তার বাড়ি। অতঃপর গেছিলাম একদিন লক্ষ্মী স্যারের অনুরোধ রাখতে। তবে বিশেষ টান আর বজায় রাখতে পারিনি। এখন কথা হলো, এই বিচিত্র বিদ্যালয়টিতে কিভাবে পৌঁছালাম আমি? বালি অঞ্চলের কোনো তথাকথিত লেখাপড়া জানা ছাত্র আমার সময়ে সাহস করে এই ইস্কুলে পড়তে যেত না। একটু আধটু পড়াশোনা করতাম আমিও। তাই দশচক্রে না হলে ওই ইস্কুলে পদার্পণের সুযোগ ছিল না আমার। অবশ্য এই শান্তিরাম ইস্কুলের ছাত্র ছিলেন আমার বাবাও। তিনি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করেন এখান থেকেই। তবে তাঁর সময়ে এই বিদ্যালয় এত বিপরীত খ্যাতি অর্জন করেনি। বরঞ্চ বলা যায়, আমার বাবার সময়ে এই ইস্কুলের বেশ নামডাকই ছিল। কিন্তু আমার বেলা কি হলো তাহলে? আসলে দশ ক্লাস অবধি প্রকৃত লেখাপড়া করি উত্তরপাড়ার মডেল ইস্কুলে। প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী, ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৫ এই এগারো বছর। আমার পরম শ্রদ্ধেয় স্যার শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়েই আমার সম্পূর্ণ শিক্ষার বারো আনা অর্জিত হয়।

ছবি ২: উত্তরপাড়া মডেল স্কুল
আমি যে সময়ে উত্তরপাড়ার মডেল ইস্কুলে যেতে শুরু করি, তখন সেটি জুনিয়র হাই স্কুল, অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সরকারি স্বীকৃত ছিল। নবম এবং দশম শ্রেণীতে আমাদের ইস্কুলে কিছু ক্লাস হলেও অন্য ইস্কুলের মাধ্যমে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে হতো। ইস্কুলের সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় পঞ্চম শ্রেণী থেকেই আমাদের ইস্কুলের ছাত্ররা বেশিরভাগই অন্য জায়গায় চলে যেত। আমার মত যাদের যাদের বাবা মা মডেল ইস্কুলের পঠন পাঠন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত বোধ করতেন, তারাই শেষ পর্যন্ত থেকে যেতো ওখানে। নবম শ্রেণীতে যখন উঠলাম, তখন ক্লাসে ছিল সাকুল্যে কুড়ি বাইশ জন। তিনটি মেয়ে আর বাকি সব ছেলেরা। এত কম সংখ্যক ছাত্র থাকায় আমাদের ক্লাস হতো অনেকটা প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের মতো। শিক্ষিকাদের, যাদের আমরা দিদিমনি বলতাম, সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল সহজ, একেবারে বাহুল্যবিহীন। মাধ্যমিক পরীক্ষা হতো নবম আর দশম এই দুই শ্রেণীর পড়াশোনার শেষে। আমাদের ইস্কুলে নবম শ্রেণীর শুরুর থেকেই পড়াশোনার ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া হতো। সকলের মনোযোগ পড়াশোনার দিকে থাকে না, তা সব যুগেই সত্য। দিদিমনিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন সকলের প্রতি নজর দিতে। কিন্তু যে পরীক্ষা কেন্দ্রীক জীর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বড়ো হয়েছি, তাতে সব ছাত্রছাত্রীর ভালোলাগার জগৎ উন্মুক্ত করার বিশেষ ক্ষেত্র ছিলো না। যেমন করে হোক পরীক্ষায় পাশ করতে হবে -- এই ক্লিষ্ট মধ্যবিত্ত বোধ আমাদের চিন্তার জগৎ আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। বলা বাহুল্য এর থেকে বেরোনোর কোনো চেষ্টা করিনি।

ছবি ৩: দিদিভাই, শ্রীমতী শিপ্রা সরকার
ক্লাস নাইনে উঠতেই বাংলার ক্লাস নিতেন দিদিভাই, আমাদের সকলের প্রিয় হেডমিস্ট্রেস শ্রীমতী শিপ্রা সরকার। এই ক্লাসটি ছিল আমার কাছে এক বিশেষ আকর্ষণের। কি যে এক অদ্ভুত সাহিত্য পড়ানোর গতি ছিল দিদিভাইয়ের। বাংলা পাঠ্য বইয়ের দুটি অংশ -- গদ্য আর কবিতা। দিদিভাই পড়াতেন কবিতার অংশটি। কৃত্তিবাস ওঝা, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দীন, অমিয় চক্রবর্তী, কত কবির যে কবিতা শুনতাম তাঁর মুখে, আর তাদের সাবলীল ব্যাখ্যা। সেই ক্লাস এমন এক সুন্দর অভিজ্ঞতা যে আমি কবিতার প্রেমে পড়ে গেলাম। সিলেবাসে যে কবিতাগুলো ছিল না, বাড়িতে পড়ার টেবিলে বসে সেগুলিও পাঠ করতাম, জোরে জোরে। কি যে আবেশ লাগতো তখন, শব্দ পাঠের ভালোলাগা, সে যেনো এক ঘোর। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সেই কবিতার আবেশ বজায় ছিল।



ছবি ৪: শ্রী কমল চট্টোপাধ্যায় 
ইংরেজি পড়াতেন কমল স্যার, শ্রী কমল চট্টোপাধ্যায়, যাকে অনেক পরে ডেকেছি মাষ্টার মশাই বলে, তাঁরই অনুরোধে। আমার জীবন জুড়ে ভালোলাগার অনেক কিছুর মূলে আছেন এই সৌম্য মানুষটি। ইস্কুলে পড়ার সাথে স্যারের উত্তরপাড়ার ফ্ল্যাটে ওনার কাছে ইংরেজি পড়তে যেতাম। আমার সাথে যেত সহপাঠী পুষ্পরাগ। পড়ানোর বাইরে কতকিছুর যে আলোচনা হতো ওনার সঙ্গে। ভারতের ইতিহাস থেকে রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, সিনেমা অনেক কিছু। স্যার বলতেন পাঠ্যবইয়ের বাইরে ইংরেজি গল্পের বই পড়তে, তবেই প্রকাশ ক্ষমতা বাড়বে। ক্লাসিক সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ আনিয়ে বাড়িতে বসে পড়তাম। এমনি করে দিনের পর দিন চলতো আমার ইংরেজি শেখা, ভাষার সাথে সহবাস। ইংরেজি ক্লাসে না বোঝা শব্দের বাংলা ব্যাখ্যা করা মোটেই পছন্দ হতো না স্যারের। বলতেন, ভাষাকে ব্যবহারের মাধ্যমে শিখতে হয়, অনুবাদের মাধ্যমে নয়। কত ধৈর্যে, কত যত্নে, কত উদাহরণের সাহায্যে বিষয়কে বোধ্য করার চেষ্টা করতেন আমার কাছে। আরও বলতেন, ইংরেজি ভাষা শিখতে গেলে ইংরেজি ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজন নেই, দরকার হলো ভাষার প্রয়োগ কৌশল শেখা। তাঁর কাছে শোনা কতটুকুই বা আমি শিখতে পেরেছি। ইস্কুল ছাড়ার এত বছর পরেও আমার পছন্দের এই মানুষটির সাথে যোগাযোগ কখনো ছিন্ন হয়নি।

এরপরে আসি অঙ্কের ক্লাসে। নবম শ্রেণী থেকে পাটিগণিত আর বীজগণিতের সাথে যুক্ত হয় ত্রিকোণমিতি আর জ্যামিতিক কিছু প্রমাণ যার নাম সম্পাদ্য আর উপপাদ্য। এদের তফাৎ আর ব্যাখ্যা আজ আর স্মরণে নেই, তবে সেই সব ক্লাসের কথা মনে আছে। পাটিগণিতের ক্লাস নিতেন মিনতি দিদিমনি। রাগী প্রকৃতির মিনতি দিদিমনিকে ক্লাস ফাইভ থেকেই ভয় পেতাম। দুর্বিনীত ছাত্রদের ওপর ভয়ঙ্কর ক্রোধ নেমে আসতো ওনার। আর শুধু ছাত্ররা কেনো, প্রহারের প্রয়োজন পড়লে উনি ছাত্র বা ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। সবসময় যে প্রহারেরই প্রয়োজন পড়তো, তা নয়। ওনার মুখের কথাও ছিল যথেষ্ট। ওনার কিছু বাক্য তো রীতিমতো প্রবাদের মতো হয়ে ছিল, যেমন হাড় সেঁকে দেবো। নিচু ক্লাসে একবার মৌখিক পরীক্ষা চলছে। দিদিমনির সামনে গিয়ে এক এক করে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। কিছু ছাত্র শেষ মুহূর্তেও বই পড়ে নিচ্ছে। বজ্রের মত নেমে এলো মিনতি দিদিমনির কণ্ঠস্বর, মরণকালে হরিনাম হচ্ছে। আর একবার, আমারই ক্লাসের একটি মেয়েকে ইস্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে নাচের জন্য প্রস্তুত করানো হচ্ছিল। গানটি বোধ হয় "বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের"। তো সেই মেয়েটি কিছুতেই নাচ তুলতে পারছে না। মিনতি দিদিমনি ক্লাসে এসে তাকে জানালেন, পড়াশোনায় যখন তোর একেবারেই মতি নেই, অন্ততঃ নাচটা তো চেষ্টা করতে পারিস। কিন্তু সেও যখন হলো না, কি হবে এই মেয়ের। ছাত্ররা আড়ালে মিনতি দিদিমনিকে বলতো "মাসি"। সব দেশেকালেই বোধ হয় শিক্ষকদের একটি ছাত্রপ্রদত্ত নাম থাকে। "মাসি" নামটি এমন কিছু গর্হিত নয়। তবে এই নামের সাথে দুষ্টু ছাত্ররা একটু মজাও করে নিতো, আর সকলেই সামিল হতো তাতে। বীজগণিত আর ত্রিকোণমিতির ক্লাস নিতেন মনিদীপা দিদিমনি। তার সাথে আরও একটি বিষয় পড়াতেন -- ভৌতবিজ্ঞান। কি সুন্দর করেই না জটিল সব তত্ত্ব সহজ করে তুলতেন আমাদের সামনে। সিমেন্টের কালো বোর্ডে চক দিয়ে এঁকে বোঝাতেন জ্যামিতিক নকশার প্রমাণ, রাসায়নিক সব বিক্রিয়ার কার্যকলাপ, পর্যায় সারণী আর ত্রিকোণমিতির মাপজোক। কি যে ভালো লাগতো সেই সব ক্লাস করতে, বিশ্বরহস্যের সেই সব প্রাথমিক ধাপ বুঝতে আর খাতায় লিখতে। পরবর্তী কালে যখন বেলুড় স্কুলে পড়েছি, উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে, একই বিষয়গুলো আবার পড়তে হতো। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষকের অভাবে ওইসব তত্ত্বগুলো ক্লাসে বসে শুনতে আর ভালো লাগতো না। মনে হতো, কতক্ষণে বাড়ি ফিরে নিজের কাজ করবো। শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক। যেকোনো কঠিন বিষয়বস্তু ছাত্রের সামনে বোধ্য করে তুলতে পারেন প্রকৃত শিক্ষক।

ভূগোল ক্লাস নিতেন ঝর্ণা দিদিমনি। এই বিষয়টির দুটো ভাগ ছিল -- প্রাকৃতিক ভূগোল আর আঞ্চলিক ভূগোল। প্রথম ভাগটিতে রয়েছে পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিচয়, অর্থাৎ কিভাবে তৈরি হয়েছে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, অক্ষরেখা, নিরক্ষরেখা, গোলার্ধের হিসাব এই সব। আর দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ আঞ্চলিক বিভাগে পৃথিবীর নানান প্রান্তরের পরিচয়, তার সাথে ভারতের পাহাড়, সমুদ্র, সমতল, মরুভূমি, মালভূমি, এই সব কিছুর একটা বিন্যাস চিত্র। ঠাকুরদা আর বাবার প্রভাবে আমার মন চিরকাল সুদূরের কথায় পিপাসিত হয়। এই ভূগোল ক্লাস আমাকে জগৎ সংসারের সেই দরজাগুলো খুলে দিত। কি যে আনন্দ পেতাম ওই সব বিষয়গুলি শুনতে, বুঝতে। ঝর্ণা দিদিমনি এক তাড়া ম্যাপ হাতে ক্লাসে ঢুকতেন। স্কেল হাতে পৃথিবীর নানান অঞ্চল বুঝিয়ে চলতেন ওনার বিশেষ ভঙ্গিতে। কত মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনতাম শুধু ভালো লাগার তাগিদে।

এই ছোট লেখার পরিসরে সকলের কথা আলাদা করে লেখার সুযোগ নেই। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন চন্দনা দিদিমনি। ক্লাস নাইন থেকে যাদের ঐচ্ছিক বিষয় ছিল বায়োলজি, তাদেরও ক্লাস নিতেন উনি। আমার ঐচ্ছিক বিষয় ছিল ফিজিক্স। আমরা দুজন ছিলাম ওই ক্লাসটিতে, আমি আর সুমন মজুমদার। পড়াতেন মনিদীপাদি। উনি ইস্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে বিজ্ঞান আর অঙ্ক ক্লাস নিতেন নবাগত নিমাই স্যার। আমরা নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কমল স্যারও শারীরিক কারণে ইস্কুল ছেড়ে দেন। এই সময় আমাদের ইংরেজি পড়াতে আসেন কাবেরী দিদিমনি, শ্রীমতী কাবেরী ব্যানার্জী। অতি যত্ন সহকারে ইংরেজি ভাষার পাঠ শুরু হয় ওনার কাছে। উচ্চারণের ব্যাপারে সবিশেষ নজর দিতেন দিদিমনি। আর কি সুন্দর ভাবে যে ক্লাস পরিচালনা করতেন। সকলে চুপটি করে বসে থাকতো। ইংরেজি ক্লাসের বাইরে কাবেরী দিদিমনির কাছে শুনে আরও একটি নতুন বিষয়ের ওপর আগ্রহ জন্মায় আমার, তা হলো পাহাড়ে বেড়ানো বা ট্রেকিং। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে কাবেরী দিদিমনির ট্রেকিং ক্লাবের সাথে বেড়িয়ে আসি আমি, দার্জিলিং হিমালয়ের কাছে সন্দকফুতে। কিন্তু সে এক অন্য গল্প। 

ছবি ৫: ইস্কুলের শিক্ষকেরা 
আমাদের ইতিহাস পড়াতেন সোমা দিদিমনি। এই একটি বিষয়ের ওপর আমার ক্লাসের বেশির ভাগের ছিল চূড়ান্ত ভীতি। ক্লাস সেভেন থেকে শুরু করে ক্লাস টেন -- এই চার বছর ইতিহাস বিষয়টির ওপর যে অসম্ভব ভীতি দেখেছি, অঙ্ক পরীক্ষা দিতেও কাউকে অত ভীত হতে দেখিনি। অন্য ইস্কুলের ছেলেরা বলতো ইতিহাস লেখা আবার কোনো ব্যাপার? একটা কোনো প্রশ্ন এলেই তার উত্তর লিখবো ফেনিয়ে ফেনিয়ে। তাতেই পাতা ভরে যাবে। ভারতের মানুষের ইতিহাসের বোধ এমনিতেই যথেষ্ট চিন্তার কারণ। মোদী এবং তার মূর্খ ভক্তবৃন্দের ভ্রান্ত ইতিহাস চেতনা আমার মনে সতত বিস্ময় জাগায়। স্কুলপাঠ্য কোনো বই ছাড়া ইতিহাসের কোনো খবর তারা রাখেন না। এখন আমার ইতিহাস ক্লাসের কথা বলতে বসে সেই ধান ভানতে শিবের গীত মনে পড়ছে। মাধ্যমিকের ইতিহাস পরীক্ষার দিনের কথাও একটু বলি তাহলে। আমাদের সিট পরেছিলো বালি দুর্গাপুর অঞ্চলের পল্লীমঙ্গল ইস্কুলে। পরীক্ষার দিন আমার সহপাঠীদের সকলের মুখ চুন। এক অজানা ভয় সকলকে গ্রাস করছে। কি না জানি প্রশ্নপত্র আসবে। আমাদের সাথেই ওখানে সিট পরেছিলো বালির শিক্ষানিকেতন বিদ্যালয়ের। তাদের ছাত্রদের মুখে সেদিন খুশির জোয়ার। অঙ্ক, ইংরেজি এসব আতঙ্কের দিন তো আগেই পেরিয়ে গেছে। ইতিহাসের তরী পার করতে আর কিসের চিন্তা? বিষয়টি সম্পর্কে এত ভয়ের কি ছিল সেটা ভাবলে এখনও অবাক লাগে আমার। আমি কলেজ জীবনে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করিনি। কিন্তু মাধ্যমিকের সময় বিষয়টি পড়তে ভালোই লাগতো। টেস্ট পরীক্ষার পরে যখন তিন মাসের ছুটি, তখন সাইকেলে করে চলে যেতাম উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরীতে। অন্য বইয়ের সাথে বিভিন্ন লেখকের ইতিহাস বইও পড়তাম। লাইব্রেরির অজস্র বইয়ের গন্ধের সাথে মিশে যেতো আমার পড়া। শুধু পরীক্ষার কথা মনে থাকতো না। ইতিহাসের ওপর সেই ভালোবাসা আজও রয়ে গেছে, এত বছর পরেও।

ছবি ৬: ইস্কুলের পুনর্মিলন উৎসব, ২০০৫ 
আমার সহপাঠীদের কথা না বললে এই লেখা সম্পূর্ণ হবে না। আগেই বলেছি, অল্প কয়েকজনে মিলে ক্লাস করতাম আমরা। অন্য ইস্কুলের সাহায্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার মধ্যে একটা বিরাট দুশ্চিন্তা ছিল। ক্লাসের সকলের মধ্যে একটা উদ্বেগ তৈরি হয়ে ছিল। ছেলেদের জন্য বালি শান্তিরাম, আর মেয়েদের দক্ষিণেশ্বরে একটি বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে হতো। ক্লাস টেনে উঠে আমাদের ক্লাসের বেশ কয়েকটি ছেলে আমাদের ইস্কুলে আর ভর্তি হলো না। সরাসরি শান্তিরাম ইস্কুলেই ক্লাস করতে চলে গেলো। যে কজন আমরা এখানে থেকে গেলাম তাদের মধ্যে রয়েছে প্রলয়, সুদীপ্ত, সুকান্ত, প্রাঞ্জল, পার্থ, গৌতম, সুদীপ, সুরজিৎ (চাচা) এবং আমি, আর তিনজন মেয়ে কুমকুম, অনিন্দিতা, শানু। মডেল ইস্কুলে আমরা ক্লাস টেনের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা অবধি দিয়েছি। একতলার বাঁদিকের ছোট একটি ঘরে হতো আমাদের ক্লাস। জনা বারো ছেলেমেয়ে আমরা অনায়াসে সেখানে বসতে পারতাম। বুঝতে পারছিলাম আমাদের ইস্কুলের জীবন শেষ হয়ে আসছে। আগেই বলেছি মাধ্যমিক পরীক্ষাকে সেসময় মনে করা হতো জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা। এর উপরে নির্ভর করবে আমাদের বাকি ভবিষ্যত। একটি পরীক্ষার গুরুত্ব সত্যিই এতটা নয়। তবে চাকুরীর স্বপ্নে মগ্ন বাঙালি সমাজে এমন ভাবেই সেদিন ভাবা হতো, সে কথাই শুধু মনে করছি। নাইন আর টেন এই দুই ক্লাসেই কিন্তু বেশ কিছু মজা হতো। নবম শ্রেণীতে পড়তে আমরা আয়োজন করলাম গরমের ছুটির আগের রবীন্দ্র জয়ন্তী। ছুটি পরার আগের দিন দুপুরে হতো এই অনুষ্ঠান। সব দায়িত্ব আমাদের। অবশ্য সাহায্য করার জন্য ছিলেন জয়শ্রী দিদিমনি। কি কি গান, কবিতা, নাচ হবে সেই সব উনি দাঁড়িয়ে থেকে দেখে নিলেন। পুরোভাগে আমরা। বেশ কিছুদিন ধরে নিচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মহড়া চালানো হলো। অনুষ্ঠানের দিন সব কিছু ঠিক মতোই হলো। শুধু আমরা কজন একটা নির্দিষ্ট গান গাইলাম না। কারণ আমাদের গলা খারাপ, উঁচুতে গাইবার সামর্থ্য ছিল না। গানটি হলো, আমরা নূতন যৌবনের দূত। প্রথম যৌবনে নানান কিছু দুঃসাহস দেখানোর চেষ্টা করতো অনেকেই। তার মধ্যে প্রধান ছিল শিক্ষকদের একটু রাগিয়ে দেওয়া। দিদিমনি বা স্যার একটু রেগে গেলে তখনই সেই দুঃসাহসের সার্থকতা ভাবা হতো। একদিনের কথা মনে পড়ছে। ক্লাস টেনের কোনো একটি ক্লাস চলছে। একতলায় আমাদের পিছনের ঘরেই বসতো আমাদের এক ক্লাস ছোট নাইনের ছাত্ররা। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল সাংঘাতিক বিচ্ছু। দুই ঘরের মাঝখানে যে দেওয়াল, ক্লাস চলাকালীন হঠাৎ সেখানে গুমগুম শব্দ হতে লাগলো, মানে লাথির আওয়াজ। যে শিক্ষিকা পড়াচ্ছিলেন, তিনি পিছনের ঘরে গিয়ে দেখলেন অন্য ক্লাসে ওইসময় কোনো শিক্ষক নেই। তিনি তো তাদের বকে ঝকে আমাদের ক্লাসে ফিরে এলেন, কিন্তু আবার সেই গুমগুম শব্দ বেড়ে গেলো। অতঃপর আবারও বকা, কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। এর ফলশ্রুতি হলো ক্লাসই বন্ধ। রাগ করে দিদিমনি চলেই গেলেন, আর সেই বীরত্বে দুই ক্লাসেরই আনন্দ। ইংরেজি শিক্ষক শিবেন্দু ত্রিপাঠিকে আমারই ক্লাসের এক সহপাঠী একবার হামি খেতে গেছিলো। স্যারের সেই রাগত মুখ দেখে তার খুশি আর ধরে না। আর তা দেখে সারা ক্লাসে হাসির হিড়িক পড়ে গেলো। আরও একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ক্লাস টেনের একটি বেঞ্চের ভিতর ঘুন ধরে গেছিলো। সেখান থেকে প্রতিদিনই কিছু ঘুনের গুঁড়ো ঝরে পরতো। ক্লাসের দুষ্টু শিরোমণি গৌতম সেই গুঁড়োর নাম দিল "প্রাকৃতিক" আর তারপর কারণে অকারণে চললো সেই গুঁড়ো সকলকে মাখানো। ডেস্কের নিচে মাখিয়ে রাখলে পা তুললেই নীল প্যান্টে ঘুণের গুঁড়োর ছাপ লেগে যাবে। এসব নানান ঘটনাতে মিলিয়ে মিশিয়ে চলতো ভেজালযুক্ত আনন্দ। ১৯৯৪ সালে আমরা দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন মিস ইউনিভার্স হলেন সুস্মিতা সেন। আনন্দবাজারে সে খবর ফলাও করে ছাপানো হলো। টিভি খুললেই তখন সুস্মিতার দন্তরুচি বিকশিত স্বল্প বাসের ছবি। বামঘেঁষা পত্রিকাগুলো ভারতীয় নারীর বিশ্ববিজয়ে বিদেশি পণ্যের বাজার দখলের গন্ধ পেলো। কিন্তু এমন একটি খবর সেদিন যৌবনের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া অতিথিদের মনে পুলক জাগিয়েছিল। 

যে মজার দিনগুলো কেটেছিলো মডেল স্কুলের ঘরগুলোতে, শান্তিরাম ইস্কুলের কয়েক দিনের ক্লাসেই তার বিপরীত পরিচয় পেলাম। এই নিবন্ধের শুরুতে তার কিছু নিদর্শন দিয়েছি। আসলে সরকারি বিদ্যালয়ের পঠন ব্যবস্থা ওই সময় থেকেই তলানিতে এসে ঠেকেছিল। স্কুলের পড়াশোনা যে প্রয়োজনীয় নয়, একথা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। আসল পড়া হলো গৃহ শিক্ষকের কাছে নিত্যদিনের হাজিরা। বেশ কিছু সরকারি শিক্ষক এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সকাল সন্ধ্যা নিজের বাড়িতে টোল খুলে রেখেছিলেন। সরকারি উপার্জনের বাইরে এই প্রাইভেট টোল রীতিমতো অর্থ সমাগম ঘটাতো। এই ব্যবস্থার শিকার হয়ে আমিও যেতাম এক দুজন শিক্ষকের বাড়িতে। প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষার নম্বর বাড়ানো। নবম আর দশম শ্রেণীতে অঙ্ক আর বিজ্ঞানের পাঠ নিতাম যার কাছে, সেখানে মাদুর বিছিয়ে বিরাট দলের ক্লাস চলতো। কোনো কারণে সেই শিক্ষক আমাদের মডেল ইস্কুলের ওপর রীতিমতো ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাই সময় বিশেষে আমাকে শুনতে হতো আমার ইস্কুল নির্বাচনের ব্যাপারে বিরাট বিপদের কথা। তিনি আরো বোঝাতে চাইতেন যে আমার ইস্কুলের শিক্ষকরা কত কম জ্ঞানী। একেই শান্তিরাম ইস্কুল নিয়ে চিন্তা, তার সাথে এই শিক্ষকের বক্তব্য আমার উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলতো। এখানে আরও একটি গল্প না বললে ভদ্রলোকের অপরিসীম জ্ঞানের কাহিনী অসম্পূর্ণ থাকবে। পড়ানোর বাইরে নানান প্রসঙ্গে আষাঢ়ে গল্প ছিল ওনার টোলের বৈশিষ্ট্য। এই ভদ্রলোকের একটি প্রিয় প্রসঙ্গ ছিল নিউটন না রবীন্দ্রনাথ, এদের মধ্যে কে বেশি বড়ো? ওনার পক্ষ ছিল নিউটনের দিকে, কারণ তিনি অসামান্য বিজ্ঞানী আর উনি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আর রবীন্দ্রনাথ মানেই শান্তিনিকেতন, আর কে না জানে শান্তিনিকেতন মানেই গাছের তলা। উনি ব্যঙ্গ করে বলতেন, গাছের তলায় একটু আধটু দুকলম কবিতা লেখা যায়, কিন্তু বিজ্ঞান চর্চা? উঁহু, কভি নেহি। এই শিক্ষকের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, নিউটন ইচ্ছা করলেই রবীন্দ্রনাথ হতে পারতেন। কিন্তু সাতজন্ম চেষ্টা করলেও রবীন্দ্রনাথ নিউটন হতে পারতেন না। মাদুরের ওপর বাবু হয়ে বসে আমি এই অসামান্য শিক্ষকের জ্ঞানের তাপে কাবাব হতাম। শান্তিরাম ইস্কুলের একটি ঘটনা দিয়ে স্কুল জীবনের এই অধ্যায় শেষ করবো। ওই বিদ্যালয়ের এক দোর্দণ্ড প্রতাপ মানুষ ছিলেন ক্রীড়াশিক্ষক সুশান্ত বাবু। লম্বাটে এবং সরু গোঁফের অধিকারী এই শিক্ষকের প্রচন্ড তেজে শান্তিরাম ইস্কুলের সব কাকুর দল এক ঘাটে জল খেত। খেলার মাঠে ওখানে সকালের প্রার্থনা হতো জাতীয় সঙ্গীত। তার পরিচালক ছিলেন সুশান্ত বাবু। যখনই এই পর্বটি চলতো, তখনই বালি ব্রিজ দিয়ে যেত কোনো রেলগাড়ি। তার শব্দে জাতীয় সঙ্গীতের কয়েকটি শব্দই কেবল বোধগম্য হতো, তা হলো ঝন ঝন ঝন ঝন। এই শব্দেই দেশের জয়গাথা গাইতাম আমরা। এহেন সুশান্ত বাবুর কাছে পি.টি. অর্থাৎ ক্রীড়া পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর সমস্যার মুখে পড়ি। টেস্ট পরীক্ষার সময় যেদিন পি.টি. ছিল সেদিন নিয়ম ছিল গেঞ্জি পরে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কোন ধরনের গেঞ্জি সে তো আর বলা ছিলনা। আমি পরে গেছিলাম হাফহাতা গেঞ্জি, বাকিরা সকলেই স্যান্ডো গেঞ্জি। পরীক্ষার আগে জামা খোলার সাথে সাথেই আমি সুশান্ত বাবুর চোখে অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেলাম। আমার পরীক্ষা নেবেন না বলে স্থির করলেন এই ক্রীড়া সম্রাট। ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা চালালাম। আমার বন্ধু সোমনাথও কিছু বোঝাতে গেলো ওনাকে। কিন্তু, এত বড় অপরাধের কোনো ক্ষমা মিললো না। অতএব পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে হলো। কাঁদিনি হয় তো, কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমার কাছে এতো তখন জীবনের সবচাইতে বড়ো পরীক্ষা। এই দোর্দণ্ড প্রতাপ মাধ্যমিকের আসল পরীক্ষায় আমাকে সুযোগ দেবেন তো? এই আশঙ্কায় কেটে গেল টেস্টের পরের দিনগুলো।

১৯৯৫ সনের ৭ই মার্চ থেকে আমাদের মাধ্যমিক শুরু হলো। শ্রীকান্তদার রিকশায় চড়ে প্রতিদিন পল্লীমঙ্গল স্কুলে যেতাম পরীক্ষা দিতে। সাথে প্রতিদিন বাড়ির কেউ না কেউ থাকতো। ফেরার সময় আবার শ্রীকান্তদা চলে যেতো। তখন একাই ফিরতাম। পরীক্ষার আগের তিনমাস যে আশঙ্কার মধ্যে কেটেছিলো তার শেষ হতে চললো। পরীক্ষা চলাকালীন আমার বাবা ছিলেন দিল্লীতে। তখন তো আর বাড়িতে ফোন নেই। বাড়ি থেকে কিছু দূরে মিনু পিসির বাড়িতে তিনি ফোন করতেন। সেখানে গিয়ে তাকে পরীক্ষার খবর জানাতাম। লিখিত পরীক্ষার আগে কিংবা পরে শান্তিরাম ইস্কুলে আবার পি.টি. আর ওয়ার্ক এডুকেশন পরীক্ষা দিতে যেতে হলো। এবার আর হাফহাতা গেঞ্জি পরে যাইনি। কিন্তু আমি তো খেলাধুলায় কোনোদিনই পারদর্শী নই। সেখানে আমাকে বলা হলো ফুটবল পায়ে কিছু ছেলের মাঝখান দিয়ে কাটিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি আর পারবো কি করে? ক্ষমাঘেন্না করে সুশান্ত বাবু সে যাত্রা আর আমাকে পরীক্ষা থেকে বাদ দিলেন না, উতরে দিলেন। আমাদের মডেল ইস্কুলে কোনো খেলার মাঠ ছিল না। ইস্কুল বাড়ির চারতলার ঘরে পূর্ণিমা দিদিমনি পি.টি. ক্লাসে যোগাসন করাতেন। এখন ভাবি, আরও কত কিছু তো হতে পারতো এই ধরনের ক্লাসে, যার যেমন ভালো লাগে, তেমন কিছু? যেমন কাঠের কাজ, মাটির কাজ, গান, নাচ, গল্প বলা অথবা সেলাই? আমার মার খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে সেলাই শেখানোর। পাকেচক্রে সে আর হয়ে ওঠেনি। এক অবক্ষয়িত বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা দেখেছি আমি, যার মধ্যে আনন্দের উপাদান থাকতো কম। অবশ্য যদি না কেউ জোর করে তা পেয়ে থাকে। পুরুষ তৈরি করতে ফুটবল, আর মেয়ে তৈরি করতে গান আর নাচ। এই ভ্রান্তবোধের বাইরে কজনই বা যেতে পেরেছে তখন?

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোনোর দিন অজানিত আশঙ্কায় এক আত্মীয়ার বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম। আমার বন্ধু প্রলয়, সুদীপ্ত, সুকান্ত ওরা ডেকে নিয়ে গেলো শান্তিরাম ইস্কুলে ফল প্রকাশ হয়েছে দেখে। আমাদের ইস্কুল থেকে ঝর্ণা দিদিমনি আর চন্দনা দিদিমনি এসেছিলেন ফল জানতে। পাশের খবরে যে অগাধ আনন্দ পেয়েছিলাম, তা আজও মনে পড়ে। ফল যাইই হোক, আমি ছাড়পত্র পেলাম আর এক উঁচু ক্ষেত্রে পৌঁছাবার। মার কাছে টাকা নিয়ে এক বাক্স মিষ্টি কিনে আমার ইস্কুলে দিদিমনিদের সাথে দেখা করতে গেলাম। সেই ইস্কুল, যাকে একদিন কত ভালোবেসেছি। সেই ইস্কুল, যেখানে তুমুল বর্ষা হলেও যেতে ইচ্ছা করতো। সেই ইস্কুল, যেখানে শিক্ষকদের মনে হতো কত কাছের মানুষ। সর্বোপরি সেই ইস্কুল, যেখানে পেয়েছি অঞ্জলি ভরা ভালোবাসা, গ্রীষ্মের বিকেলে কাঠগোলাপের মতো। ইস্কুল ছাড়ার পরেও ওখানে গেছি বেশ কয়েকবার। আমার সময়ের শিক্ষকদের সাথে দেখা হয়েছে। স্নিগ্ধা দিদিমনির কথা আগে বলা হয়নি। দেখা হলেই কত আপন করে কথা বলেছেন, সব সময় জিজ্ঞেস করেছেন, মা কেমন আছেন। স্যারের সাথেও দেখা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই আমি দিল্লী থেকে বালিতে গিয়ে উত্তরপাড়ায় ওনার বাড়িতে দেখা করতে যাই। সেদিন তাঁর মুখে শুনলাম ইস্কুলের নানান উন্নতির কথা, নানান ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। দিদিভাই আর কয়েকজন দিদিমনির সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় ফোনে। অবসর জীবনে তাঁরা কেমন আছেন সেকথা শুনি। আমার জীবনের কথাও শুনতে চান তাঁরা। আর ইস্কুলের বন্ধুদের মধ্যে প্রলয় আর সুদীপ্তর সাথে এত বছরে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছে। ইস্কুলের কথার বাইরে এখন আমরা সাংসারিক জীবনের কথাও আলোচনা করি। বাকিদের সাথেও দেখা হয় বালির রাস্তায় মাঝে সাঝে, যখন ওখানে যাই। তাদের জীবনের খবর পাই, সংসারের খবর পাই, নতুন অতিথিদের কথা শুনি। এই সব কিছু মিলিয়েই আমার মাধ্যমিক। শুধু একটা উঁচু ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা নয়, আমার কিশোরবেলার সাথে মিলিত হবার মাধ্যম।

ছবি ৭: ১৯৯৫ সালে আমার ইস্কুলের পুরষ্কার বিতরণী সভার ছবি।
বাম দিকে শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সরকার।


শ্রদ্ধেয়া দিদিভাইয়ের মুখে বলা কবিতা, সব প্রাক্তনদের জন্য

Comments

  1. Excellent.... my friend.... hearty congratulations to the 1st boy at our class from the most notorious boy at the class. I think u will agree on the adjective which I have used here to myself. U had competitors , but i never had. I read out all the three stoires in this blog.... but it's best out of these 3.

    ReplyDelete
  2. আমি ১৯৯৬ সালে মাধ্যমিক দিয়েছিলাম। কিন্তু ইতিহাসে কোন কোন লেখকের বই পড়তাম সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। একটু সাহায্য করতে পারবেন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

বাঙাল বাড়ির ষষ্ঠী পুজো

Bengali narrative: What are we known for?