মাধ্যমিকের পঁচিশ বছর: ১৯৯৫—২০২০
আমার মাধ্যমিকের পর পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে, তো কি এমন হয়েছে? প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে দশ ক্লাসের গণ্ডি পার করে পরবর্তী জীবনে পা রাখছে। এ তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমার জীবনেও একদিন তা হয়েছে। কিন্তু সেকথা বিশেষ করে লেখার কি আছে? তা বলবো বলেই তো এই লেখার সূচনা। ১৯৯৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই পঁচিশ বছরে আমাদের সামাজিক ও বৌদ্ধিক জীবনের এক বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। যে মফস্বল শহরটিতে আমি কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছি, আজ তা কালের স্রোতে বড্ডো বেশি রকমের আধুনিক হয়ে গেছে। কর্মস্থান দিল্লী থেকে প্রতি বছর ঘরের টানে যখন সেখানে ফিরে যাই, দেখি যে সেই কিশোরবেলার রূপ বহুতর পাল্টে গেছে। যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, আমরা আমাদের যৌথ পরিবারে মাটিতে বসে পাত পেরে খেতাম। সকালে ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে ৫০ পয়সার টিকিট কেটে বাসে চড়ে ইস্কুলে যেতাম। বিকেলে বাড়ি ফিরে আবার একপ্রস্থ ভাত ডাল। সেদিন আমাদের জীবনে মোবাইল তো দূরাগত, কোনো ধরনের ফোন যোগাযোগের স্পর্শ ছিল না বাড়িতে। কম্পিউটার নামক যন্ত্রের নাম ছিল অশ্রুত, না ছিল ইমেইল অথবা অন্য কোনো প্রযুক্তির সংযোগ। কারোর খবর জানতে হলে তার বাড়িতে যেতে হতো। মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর পর আমার পাশের খবর অনেককে জানিয়েছিলাম চিঠি লিখে। আজ মনে হবে পরীক্ষায় পাশের কথা অত বলার কি আছে? কিন্তু যেকালের কথা লিখতে বসেছি, সেকালে এই মাধ্যমিকের ফলের খবর পাড়ায় পাড়ায় জানা যেতো। এলাকার মানুষরা জানতো এই বছর কোন কোন ছেলেমেয়ে এই পরীক্ষায় বসতে চলেছে। কে কেমন নম্বর পেয়েছে। কে কোথায় কি নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, এই সব। এমনকি কে কার কাছে প্রাইভেট কোচিং নিতো, সেসবও। কারণ, এই মাধ্যমিক পরীক্ষা তখন ছিল বড়ো হওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আজ সেকথা ভুল মনে হলেও তখন অন্ততঃ তেমনটাই মনে করা হতো।
ছবি ১: বালি শান্তিরাম বিদ্যালয় |
ছবি ২: উত্তরপাড়া মডেল স্কুল |
ছবি ৩: দিদিভাই, শ্রীমতী শিপ্রা সরকার |
ছবি ৪: শ্রী কমল চট্টোপাধ্যায় |
এরপরে আসি অঙ্কের ক্লাসে। নবম শ্রেণী থেকে পাটিগণিত আর বীজগণিতের সাথে যুক্ত হয় ত্রিকোণমিতি আর জ্যামিতিক কিছু প্রমাণ যার নাম সম্পাদ্য আর উপপাদ্য। এদের তফাৎ আর ব্যাখ্যা আজ আর স্মরণে নেই, তবে সেই সব ক্লাসের কথা মনে আছে। পাটিগণিতের ক্লাস নিতেন মিনতি দিদিমনি। রাগী প্রকৃতির মিনতি দিদিমনিকে ক্লাস ফাইভ থেকেই ভয় পেতাম। দুর্বিনীত ছাত্রদের ওপর ভয়ঙ্কর ক্রোধ নেমে আসতো ওনার। আর শুধু ছাত্ররা কেনো, প্রহারের প্রয়োজন পড়লে উনি ছাত্র বা ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। সবসময় যে প্রহারেরই প্রয়োজন পড়তো, তা নয়। ওনার মুখের কথাও ছিল যথেষ্ট। ওনার কিছু বাক্য তো রীতিমতো প্রবাদের মতো হয়ে ছিল, যেমন হাড় সেঁকে দেবো। নিচু ক্লাসে একবার মৌখিক পরীক্ষা চলছে। দিদিমনির সামনে গিয়ে এক এক করে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। কিছু ছাত্র শেষ মুহূর্তেও বই পড়ে নিচ্ছে। বজ্রের মত নেমে এলো মিনতি দিদিমনির কণ্ঠস্বর, মরণকালে হরিনাম হচ্ছে। আর একবার, আমারই ক্লাসের একটি মেয়েকে ইস্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে নাচের জন্য প্রস্তুত করানো হচ্ছিল। গানটি বোধ হয় "বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের"। তো সেই মেয়েটি কিছুতেই নাচ তুলতে পারছে না। মিনতি দিদিমনি ক্লাসে এসে তাকে জানালেন, পড়াশোনায় যখন তোর একেবারেই মতি নেই, অন্ততঃ নাচটা তো চেষ্টা করতে পারিস। কিন্তু সেও যখন হলো না, কি হবে এই মেয়ের। ছাত্ররা আড়ালে মিনতি দিদিমনিকে বলতো "মাসি"। সব দেশেকালেই বোধ হয় শিক্ষকদের একটি ছাত্রপ্রদত্ত নাম থাকে। "মাসি" নামটি এমন কিছু গর্হিত নয়। তবে এই নামের সাথে দুষ্টু ছাত্ররা একটু মজাও করে নিতো, আর সকলেই সামিল হতো তাতে। বীজগণিত আর ত্রিকোণমিতির ক্লাস নিতেন মনিদীপা দিদিমনি। তার সাথে আরও একটি বিষয় পড়াতেন -- ভৌতবিজ্ঞান। কি সুন্দর করেই না জটিল সব তত্ত্ব সহজ করে তুলতেন আমাদের সামনে। সিমেন্টের কালো বোর্ডে চক দিয়ে এঁকে বোঝাতেন জ্যামিতিক নকশার প্রমাণ, রাসায়নিক সব বিক্রিয়ার কার্যকলাপ, পর্যায় সারণী আর ত্রিকোণমিতির মাপজোক। কি যে ভালো লাগতো সেই সব ক্লাস করতে, বিশ্বরহস্যের সেই সব প্রাথমিক ধাপ বুঝতে আর খাতায় লিখতে। পরবর্তী কালে যখন বেলুড় স্কুলে পড়েছি, উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে, একই বিষয়গুলো আবার পড়তে হতো। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষকের অভাবে ওইসব তত্ত্বগুলো ক্লাসে বসে শুনতে আর ভালো লাগতো না। মনে হতো, কতক্ষণে বাড়ি ফিরে নিজের কাজ করবো। শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক। যেকোনো কঠিন বিষয়বস্তু ছাত্রের সামনে বোধ্য করে তুলতে পারেন প্রকৃত শিক্ষক।
ভূগোল ক্লাস নিতেন ঝর্ণা দিদিমনি। এই বিষয়টির দুটো ভাগ ছিল -- প্রাকৃতিক ভূগোল আর আঞ্চলিক ভূগোল। প্রথম ভাগটিতে রয়েছে পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিচয়, অর্থাৎ কিভাবে তৈরি হয়েছে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, অক্ষরেখা, নিরক্ষরেখা, গোলার্ধের হিসাব এই সব। আর দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ আঞ্চলিক বিভাগে পৃথিবীর নানান প্রান্তরের পরিচয়, তার সাথে ভারতের পাহাড়, সমুদ্র, সমতল, মরুভূমি, মালভূমি, এই সব কিছুর একটা বিন্যাস চিত্র। ঠাকুরদা আর বাবার প্রভাবে আমার মন চিরকাল সুদূরের কথায় পিপাসিত হয়। এই ভূগোল ক্লাস আমাকে জগৎ সংসারের সেই দরজাগুলো খুলে দিত। কি যে আনন্দ পেতাম ওই সব বিষয়গুলি শুনতে, বুঝতে। ঝর্ণা দিদিমনি এক তাড়া ম্যাপ হাতে ক্লাসে ঢুকতেন। স্কেল হাতে পৃথিবীর নানান অঞ্চল বুঝিয়ে চলতেন ওনার বিশেষ ভঙ্গিতে। কত মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনতাম শুধু ভালো লাগার তাগিদে।
এই ছোট লেখার পরিসরে সকলের কথা আলাদা করে লেখার সুযোগ নেই। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন চন্দনা দিদিমনি। ক্লাস নাইন থেকে যাদের ঐচ্ছিক বিষয় ছিল বায়োলজি, তাদেরও ক্লাস নিতেন উনি। আমার ঐচ্ছিক বিষয় ছিল ফিজিক্স। আমরা দুজন ছিলাম ওই ক্লাসটিতে, আমি আর সুমন মজুমদার। পড়াতেন মনিদীপাদি। উনি ইস্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে বিজ্ঞান আর অঙ্ক ক্লাস নিতেন নবাগত নিমাই স্যার। আমরা নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কমল স্যারও শারীরিক কারণে ইস্কুল ছেড়ে দেন। এই সময় আমাদের ইংরেজি পড়াতে আসেন কাবেরী দিদিমনি, শ্রীমতী কাবেরী ব্যানার্জী। অতি যত্ন সহকারে ইংরেজি ভাষার পাঠ শুরু হয় ওনার কাছে। উচ্চারণের ব্যাপারে সবিশেষ নজর দিতেন দিদিমনি। আর কি সুন্দর ভাবে যে ক্লাস পরিচালনা করতেন। সকলে চুপটি করে বসে থাকতো। ইংরেজি ক্লাসের বাইরে কাবেরী দিদিমনির কাছে শুনে আরও একটি নতুন বিষয়ের ওপর আগ্রহ জন্মায় আমার, তা হলো পাহাড়ে বেড়ানো বা ট্রেকিং। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে কাবেরী দিদিমনির ট্রেকিং ক্লাবের সাথে বেড়িয়ে আসি আমি, দার্জিলিং হিমালয়ের কাছে সন্দকফুতে। কিন্তু সে এক অন্য গল্প।
ছবি ৫: ইস্কুলের শিক্ষকেরা |
ছবি ৬: ইস্কুলের পুনর্মিলন উৎসব, ২০০৫ |
যে মজার দিনগুলো কেটেছিলো মডেল স্কুলের ঘরগুলোতে, শান্তিরাম ইস্কুলের কয়েক দিনের ক্লাসেই তার বিপরীত পরিচয় পেলাম। এই নিবন্ধের শুরুতে তার কিছু নিদর্শন দিয়েছি। আসলে সরকারি বিদ্যালয়ের পঠন ব্যবস্থা ওই সময় থেকেই তলানিতে এসে ঠেকেছিল। স্কুলের পড়াশোনা যে প্রয়োজনীয় নয়, একথা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। আসল পড়া হলো গৃহ শিক্ষকের কাছে নিত্যদিনের হাজিরা। বেশ কিছু সরকারি শিক্ষক এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সকাল সন্ধ্যা নিজের বাড়িতে টোল খুলে রেখেছিলেন। সরকারি উপার্জনের বাইরে এই প্রাইভেট টোল রীতিমতো অর্থ সমাগম ঘটাতো। এই ব্যবস্থার শিকার হয়ে আমিও যেতাম এক দুজন শিক্ষকের বাড়িতে। প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষার নম্বর বাড়ানো। নবম আর দশম শ্রেণীতে অঙ্ক আর বিজ্ঞানের পাঠ নিতাম যার কাছে, সেখানে মাদুর বিছিয়ে বিরাট দলের ক্লাস চলতো। কোনো কারণে সেই শিক্ষক আমাদের মডেল ইস্কুলের ওপর রীতিমতো ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাই সময় বিশেষে আমাকে শুনতে হতো আমার ইস্কুল নির্বাচনের ব্যাপারে বিরাট বিপদের কথা। তিনি আরো বোঝাতে চাইতেন যে আমার ইস্কুলের শিক্ষকরা কত কম জ্ঞানী। একেই শান্তিরাম ইস্কুল নিয়ে চিন্তা, তার সাথে এই শিক্ষকের বক্তব্য আমার উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলতো। এখানে আরও একটি গল্প না বললে ভদ্রলোকের অপরিসীম জ্ঞানের কাহিনী অসম্পূর্ণ থাকবে। পড়ানোর বাইরে নানান প্রসঙ্গে আষাঢ়ে গল্প ছিল ওনার টোলের বৈশিষ্ট্য। এই ভদ্রলোকের একটি প্রিয় প্রসঙ্গ ছিল নিউটন না রবীন্দ্রনাথ, এদের মধ্যে কে বেশি বড়ো? ওনার পক্ষ ছিল নিউটনের দিকে, কারণ তিনি অসামান্য বিজ্ঞানী আর উনি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আর রবীন্দ্রনাথ মানেই শান্তিনিকেতন, আর কে না জানে শান্তিনিকেতন মানেই গাছের তলা। উনি ব্যঙ্গ করে বলতেন, গাছের তলায় একটু আধটু দুকলম কবিতা লেখা যায়, কিন্তু বিজ্ঞান চর্চা? উঁহু, কভি নেহি। এই শিক্ষকের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, নিউটন ইচ্ছা করলেই রবীন্দ্রনাথ হতে পারতেন। কিন্তু সাতজন্ম চেষ্টা করলেও রবীন্দ্রনাথ নিউটন হতে পারতেন না। মাদুরের ওপর বাবু হয়ে বসে আমি এই অসামান্য শিক্ষকের জ্ঞানের তাপে কাবাব হতাম। শান্তিরাম ইস্কুলের একটি ঘটনা দিয়ে স্কুল জীবনের এই অধ্যায় শেষ করবো। ওই বিদ্যালয়ের এক দোর্দণ্ড প্রতাপ মানুষ ছিলেন ক্রীড়াশিক্ষক সুশান্ত বাবু। লম্বাটে এবং সরু গোঁফের অধিকারী এই শিক্ষকের প্রচন্ড তেজে শান্তিরাম ইস্কুলের সব কাকুর দল এক ঘাটে জল খেত। খেলার মাঠে ওখানে সকালের প্রার্থনা হতো জাতীয় সঙ্গীত। তার পরিচালক ছিলেন সুশান্ত বাবু। যখনই এই পর্বটি চলতো, তখনই বালি ব্রিজ দিয়ে যেত কোনো রেলগাড়ি। তার শব্দে জাতীয় সঙ্গীতের কয়েকটি শব্দই কেবল বোধগম্য হতো, তা হলো ঝন ঝন ঝন ঝন। এই শব্দেই দেশের জয়গাথা গাইতাম আমরা। এহেন সুশান্ত বাবুর কাছে পি.টি. অর্থাৎ ক্রীড়া পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর সমস্যার মুখে পড়ি। টেস্ট পরীক্ষার সময় যেদিন পি.টি. ছিল সেদিন নিয়ম ছিল গেঞ্জি পরে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কোন ধরনের গেঞ্জি সে তো আর বলা ছিলনা। আমি পরে গেছিলাম হাফহাতা গেঞ্জি, বাকিরা সকলেই স্যান্ডো গেঞ্জি। পরীক্ষার আগে জামা খোলার সাথে সাথেই আমি সুশান্ত বাবুর চোখে অকিঞ্চিৎকর হয়ে গেলাম। আমার পরীক্ষা নেবেন না বলে স্থির করলেন এই ক্রীড়া সম্রাট। ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা চালালাম। আমার বন্ধু সোমনাথও কিছু বোঝাতে গেলো ওনাকে। কিন্তু, এত বড় অপরাধের কোনো ক্ষমা মিললো না। অতএব পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি ফিরে যেতে হলো। কাঁদিনি হয় তো, কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমার কাছে এতো তখন জীবনের সবচাইতে বড়ো পরীক্ষা। এই দোর্দণ্ড প্রতাপ মাধ্যমিকের আসল পরীক্ষায় আমাকে সুযোগ দেবেন তো? এই আশঙ্কায় কেটে গেল টেস্টের পরের দিনগুলো।
১৯৯৫ সনের ৭ই মার্চ থেকে আমাদের মাধ্যমিক শুরু হলো। শ্রীকান্তদার রিকশায় চড়ে প্রতিদিন পল্লীমঙ্গল স্কুলে যেতাম পরীক্ষা দিতে। সাথে প্রতিদিন বাড়ির কেউ না কেউ থাকতো। ফেরার সময় আবার শ্রীকান্তদা চলে যেতো। তখন একাই ফিরতাম। পরীক্ষার আগের তিনমাস যে আশঙ্কার মধ্যে কেটেছিলো তার শেষ হতে চললো। পরীক্ষা চলাকালীন আমার বাবা ছিলেন দিল্লীতে। তখন তো আর বাড়িতে ফোন নেই। বাড়ি থেকে কিছু দূরে মিনু পিসির বাড়িতে তিনি ফোন করতেন। সেখানে গিয়ে তাকে পরীক্ষার খবর জানাতাম। লিখিত পরীক্ষার আগে কিংবা পরে শান্তিরাম ইস্কুলে আবার পি.টি. আর ওয়ার্ক এডুকেশন পরীক্ষা দিতে যেতে হলো। এবার আর হাফহাতা গেঞ্জি পরে যাইনি। কিন্তু আমি তো খেলাধুলায় কোনোদিনই পারদর্শী নই। সেখানে আমাকে বলা হলো ফুটবল পায়ে কিছু ছেলের মাঝখান দিয়ে কাটিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি আর পারবো কি করে? ক্ষমাঘেন্না করে সুশান্ত বাবু সে যাত্রা আর আমাকে পরীক্ষা থেকে বাদ দিলেন না, উতরে দিলেন। আমাদের মডেল ইস্কুলে কোনো খেলার মাঠ ছিল না। ইস্কুল বাড়ির চারতলার ঘরে পূর্ণিমা দিদিমনি পি.টি. ক্লাসে যোগাসন করাতেন। এখন ভাবি, আরও কত কিছু তো হতে পারতো এই ধরনের ক্লাসে, যার যেমন ভালো লাগে, তেমন কিছু? যেমন কাঠের কাজ, মাটির কাজ, গান, নাচ, গল্প বলা অথবা সেলাই? আমার মার খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে সেলাই শেখানোর। পাকেচক্রে সে আর হয়ে ওঠেনি। এক অবক্ষয়িত বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা দেখেছি আমি, যার মধ্যে আনন্দের উপাদান থাকতো কম। অবশ্য যদি না কেউ জোর করে তা পেয়ে থাকে। পুরুষ তৈরি করতে ফুটবল, আর মেয়ে তৈরি করতে গান আর নাচ। এই ভ্রান্তবোধের বাইরে কজনই বা যেতে পেরেছে তখন?
মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোনোর দিন অজানিত আশঙ্কায় এক আত্মীয়ার বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম। আমার বন্ধু প্রলয়, সুদীপ্ত, সুকান্ত ওরা ডেকে নিয়ে গেলো শান্তিরাম ইস্কুলে ফল প্রকাশ হয়েছে দেখে। আমাদের ইস্কুল থেকে ঝর্ণা দিদিমনি আর চন্দনা দিদিমনি এসেছিলেন ফল জানতে। পাশের খবরে যে অগাধ আনন্দ পেয়েছিলাম, তা আজও মনে পড়ে। ফল যাইই হোক, আমি ছাড়পত্র পেলাম আর এক উঁচু ক্ষেত্রে পৌঁছাবার। মার কাছে টাকা নিয়ে এক বাক্স মিষ্টি কিনে আমার ইস্কুলে দিদিমনিদের সাথে দেখা করতে গেলাম। সেই ইস্কুল, যাকে একদিন কত ভালোবেসেছি। সেই ইস্কুল, যেখানে তুমুল বর্ষা হলেও যেতে ইচ্ছা করতো। সেই ইস্কুল, যেখানে শিক্ষকদের মনে হতো কত কাছের মানুষ। সর্বোপরি সেই ইস্কুল, যেখানে পেয়েছি অঞ্জলি ভরা ভালোবাসা, গ্রীষ্মের বিকেলে কাঠগোলাপের মতো। ইস্কুল ছাড়ার পরেও ওখানে গেছি বেশ কয়েকবার। আমার সময়ের শিক্ষকদের সাথে দেখা হয়েছে। স্নিগ্ধা দিদিমনির কথা আগে বলা হয়নি। দেখা হলেই কত আপন করে কথা বলেছেন, সব সময় জিজ্ঞেস করেছেন, মা কেমন আছেন। স্যারের সাথেও দেখা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই আমি দিল্লী থেকে বালিতে গিয়ে উত্তরপাড়ায় ওনার বাড়িতে দেখা করতে যাই। সেদিন তাঁর মুখে শুনলাম ইস্কুলের নানান উন্নতির কথা, নানান ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। দিদিভাই আর কয়েকজন দিদিমনির সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় ফোনে। অবসর জীবনে তাঁরা কেমন আছেন সেকথা শুনি। আমার জীবনের কথাও শুনতে চান তাঁরা। আর ইস্কুলের বন্ধুদের মধ্যে প্রলয় আর সুদীপ্তর সাথে এত বছরে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছে। ইস্কুলের কথার বাইরে এখন আমরা সাংসারিক জীবনের কথাও আলোচনা করি। বাকিদের সাথেও দেখা হয় বালির রাস্তায় মাঝে সাঝে, যখন ওখানে যাই। তাদের জীবনের খবর পাই, সংসারের খবর পাই, নতুন অতিথিদের কথা শুনি। এই সব কিছু মিলিয়েই আমার মাধ্যমিক। শুধু একটা উঁচু ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা নয়, আমার কিশোরবেলার সাথে মিলিত হবার মাধ্যম।
ছবি ৭: ১৯৯৫ সালে আমার ইস্কুলের পুরষ্কার বিতরণী সভার ছবি। বাম দিকে শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল সরকার। শ্রদ্ধেয়া দিদিভাইয়ের মুখে বলা কবিতা, সব প্রাক্তনদের জন্য |
Excellent.... my friend.... hearty congratulations to the 1st boy at our class from the most notorious boy at the class. I think u will agree on the adjective which I have used here to myself. U had competitors , but i never had. I read out all the three stoires in this blog.... but it's best out of these 3.
ReplyDeleteআমি ১৯৯৬ সালে মাধ্যমিক দিয়েছিলাম। কিন্তু ইতিহাসে কোন কোন লেখকের বই পড়তাম সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। একটু সাহায্য করতে পারবেন।
ReplyDelete