গ্রন্থসমালোচনা: রবীন্দ্র নৃত্য-শিল্প — কাবেরী চট্টোপাধ্যায়
১৯১৯ সালের শেষে রবীন্দ্রনাথ যান সিলেট সফরে। সেখানে এক মণিপুরী রাসনৃত্যের অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হন কবি। ফেরার পথে ত্রিপুরায় এসে মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যকে অনুরোধ করেন তিনি যেন শান্তিনিকেতনের জন্য একজন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষককে পাঠান। কথামতো কিছুদিনের মধ্যেই আশ্রম বিদ্যালয়ে পৌঁছান রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিং। কবির আগ্রহে, আর বুদ্ধিমন্তের পরিচালনায় আশ্রমের ছাতিমতলায় শুরু হয় নৃত্যশিক্ষার পাঠ। প্রথম শিক্ষার্থী হয় ছাত্রেরা, তারপরে আগ্রহের বশে সেই ক্লাসে যোগ দেয় ছাত্রীরাও। কিছু মণিপুরী নৃত্যভঙ্গি আয়ত্ত হবার পরে কবি নির্দেশ দেন সেই ভঙ্গিগুলি তাঁর গানের সাথে মিলিয়ে নৃত্য রচনা করার। উৎসাহী ছাত্রছাত্রীরা এই নতুন সৃষ্টি কর্মে নেমে পড়ে। কবির সর্বকাজের সহায়ক প্রতিমা দেবী দায়িত্ত্ব নেন এই নাচের ক্লাসগুলি পরিচালনা করার। সূচনা হয় এক অনন্য সাংস্কৃতিক ইতিহাসের। ভারতের কোনো বিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম অন্য পঠনপাঠনের সাথে শুরু হয় নৃত্যশিক্ষা। ছাত্রীদের যোগদান সেই শিক্ষাকে নবতর মাত্রা দেয়। শান্তিদেব ঘোষ এই নতুন ধারাটিকে বলেন, শান্তিনিকেতনের নৃত্য আন্দোলন। প্রথমদিকে মণিপুরী নৃত্যের প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে সেই আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করে ভারতের নানান শাস্ত্রীয় এবং লোকনৃত্য ধারা, এমনকি ভারতের বাইরের বিভিন্ন নৃত্য। সেই আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন শ্রীমতী কাবেরী চট্টোপাধ্যায়, সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ "রবীন্দ্র নৃত্য-শিল্প"-তে।
কবির নৃত্যচিন্তার নানান ভাবনা এই গ্রন্থের একটি বিশেষ প্রাপ্তি। নৃত্যকলা কখনো তাঁর কাছে "অশ্রুত গীতছন্দের মূর্তি" আবার কখনো "নটরাজের তান্ডব"। নিজেকে কখনো "নটরাজের চেলা" বলে উল্লেখ করেন কবি। গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে, পত্রে, নানান ভাবে নৃত্যকলা সম্পর্কে তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবীর নানান প্রান্তের নাচ দেখা তাঁর মননকে সমৃদ্ধ করেছে। এই গ্রন্থের একটি অংশে বিস্তৃতভাবে সংকলিত হয়েছে গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস থেকে আহরিত রবীন্দ্রনাথের নৃত্যচিন্তা। উৎসাহী পাঠক সেখানে পাবেন নৃত্যকে নানান রূপে দেখার রসদ।
লেখিকা প্রতিষ্ঠা করেছেন যে রবীন্দ্রনৃত্যশৈলী একটি স্বতন্ত্র নৃত্যরূপের দাবি রাখে। আশ্রমের নৃত্যকলা রূপে কবি যাকে গ্রহণ করেছিলেন তাতে অন্য বিভিন্ন নৃত্যআঙ্গিক থেকে কিছু গ্রহণ করেছিলেন, আবার কিছু করেছিলেন বর্জন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে বসে সেই বিষয়গুলির একটি রূপ তৈরী করে নিয়েছিলেন। গুরুপরম্পরায় সেই আঙ্গিকগুলি ছড়িয়ে পড়েছে নানান ভাবে। নাটক এবং নৃত্যনাট্যে সাজসজ্জা এবং মঞ্চসজ্জার উপর বিশেষভাবে দৃকপাত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিভিন্ন নাটকে চরিত্র অনুযায়ী তৈরী হতো সাধারণ, অথচ দৃষ্টিনন্দন সজ্জা। তাঁর প্রবর্তিত সেই সাজসজ্জার ধারাটি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন লেখিকা। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০ পাতার এই গ্রন্থ রবীন্দ্রনৃত্যকে অনুধাবন করার একটি মূল্যবান আকর। প্রতিমা ঠাকুরের "নৃত্য" গ্রন্থের পরে রবীন্দ্রনৃত্য বিষয়ে কাবেরী চট্টোপাধ্যায়ের এই বইটি একটি বিশিষ্ট সংযোজন।
.............................
Comments
Post a Comment