|
শ্রী কালীপদ তর্কাচার্য |
বিংশ
শতকের বাংলার এক অসাধারণ সংস্কৃতজ্ঞ মহামহোপাধ্যায় কালীপদ তর্কাচার্যকে নিয়ে এই
লেখা। ভারতবর্ষে সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যের ব্যাপ্তি বহু শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত। খ্রীষ্টপূর্ব
পঞ্চম শতকে পাণিনি রচিত “অষ্টাধ্যায়ী” গ্রন্থে যে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রণালী
বর্ণিত হয়েছিল তা সৃষ্টি করেছিল এক শক্তিশালী ধ্রুপদী ভাষার। এই সুললিত ভাষায় লেখা
হয়েছে কত না অপরূপ সাহিত্য কীর্তির। কালিদাস, শূদ্রক,
ভাস, অশ্বঘোষ যেমন ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের
নাট্যকার, তেমনি ভারতীয় দর্শনকে সংস্কৃতের আধারে লিপিবদ্ধ
করেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য, রামানুজ, আদি
শঙ্করাচার্য, নাগার্জুন, বাৎস্যায়ন,
এবং আরো অনেকে। কালীপদ তর্কাচার্য ছিলেন এই বহু সাহিত্যকৃতির এক
সেতু বিশেষ। যদিও ভারতীয় ন্যায় শাস্ত্র ছিল তাঁর গবেষণা ক্ষেত্র, তাঁর প্রতিভার দীপ্তি স্পর্শ করেছিল দেবভাষার নানান সাহিত্য কীর্তি। তাঁর
সমকক্ষ সংস্কৃত গবেষক সমকালীন সময়ে বাংলায় ছিলেন বিরল। যে বিদগ্ধ পরিবারে তাঁর
জন্ম সে কথা বলেই শুরু করবো এই প্রবন্ধ। একাদশ শতকে পাল রাজত্বের সমাপ্তির পরে
হিন্দু রাজা আদিশূর কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসেন
বাংলাদেশে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এখানকার ব্রাহ্মণদের সনাতন হিন্দু দর্শনে সুশিক্ষিত
করে তোলা। এই সুজলা সুফলা দেশের শ্যামল মাটি সেই পণ্ডিতদের এতো উজ্জীবিত করে যে
তাঁরা এখানেই থেকে যাওয়া মনস্থির করেন। শুরু হয় নতুন দেশে নতুন জীবনযাত্রা। এখানেই
চলে তাঁদের নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়া, সংসার প্রতিপালন আর
জ্ঞানের ধারাটি বহন করে চলার প্রয়াস। এক এক করে সংসার বৃদ্ধিও হতে থাকে। এঁদের
সন্তান সন্ততিরা হয়ে ওঠেন একান্ত ভাবেই তৎকালীন বঙ্গদেশের নাগরিক। বাংলাই তাদের
কথ্য ভাষা, মাতৃভাষা। এদেরই মধ্যে একটি পরিবার চলে আসেন
বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলের উনশিয়া গ্রামে। নদী বিধৌত এই পল্লী অঞ্চলে
তাদের পাকাপাকি নিবাস তৈরী হয়। পরিবারের বিদগ্ধ পুরুষেরা সংস্কৃত পাঠের ধারা
এখানেও অব্যাহত রাখেন। এই পরিবারেই জন্ম হয় বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত মধুসূদন
সরস্বতীর, যাঁর রচিত বহুতথ্য সংবলিত অদ্বৈত সিদ্ধি এবং গীতার
ভাষ্য গূঢ়ার্থ দীপিকা আজও হিন্দু দর্শনের অন্যতম পাঠ্য। সেই উজ্জ্বল পারিবারিক
ধারারই সন্তান কালীপদ তর্কাচার্য।
হরিদাস তর্কতীর্থ এবং সীতাসুন্দরী দেবীর এই জ্যেষ্ঠ
সন্তানের জন্ম উনিশ শতকের শেষের দিকে, ১৮৮৮ সালে। মাত্র দুই বছর আগেই দেহান্ত হয়েছে বাংলার ধর্মসাধনার
সর্বোৎকৃষ্ট ফল শ্রীরামকৃষ্ণের। আর মাত্র কয়েকবছর পরেই ১৮৯৩ সালে তাঁর প্রধান
শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে ধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্মের উৎকৃষ্টতা প্রমান
করবেন। পরিবারের বিশ্বাস হয় রক্ষয়িত্রী দেবী কালীর আশীর্বাদে এবং শতাবৃত্তি
চণ্ডীপাঠের ফলে এই পুত্রের জন্ম। তাই নাম রাখা হয় কালীপদ। বড় হবার সাথে সাথে কালীপদর চরিত্রের উপর গভীর প্রভাব পড়ে তাঁর পিতামহ হরকুমারের। শিক্ষিত পিতা হরিদাস
পুত্রকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন বলে ফরিদপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।
কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কালীপদর শারীরিক অসুস্থতা এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রতি
অনাগ্রহ পিতাকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। উনশিয়ায় ফিরে গিয়ে কালীপদ ভর্তি হন পণ্ডিত
কালীকান্ত শিরোমনির সংস্কৃত টোলে। সেখানেই তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার বিকাশ হয়। অতি অল্প
বয়সেই সংস্কৃত ভাষায় পদ্য রচনা শুরু করেন তিনি। তাঁর মুখে শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ
শুনে মুগ্ধ হতেন শিক্ষকেরা। চলতে থাকে উচ্চতর পাঠ, গ্রামের
টোলে যেটুকু সম্ভব হয়। তবে সংস্কৃতে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে আবার ফিরে আসতেই হয়
কলকাতায়। এখানে ভুবনেশ্বর বিদ্যালংকারের কাছে শিক্ষালাভ করে ব্যাকরণ এবং কাব্যের
মধ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পরে আবার মূলাজোড় সংস্কৃত কলেজে কাব্য
এবং অলংকারের শিক্ষা নেন পণ্ডিত হরিপদ বিদ্যারত্নের কাছে। উপাধি পরীক্ষায় কালীপদ
প্রথম স্থান অধিকার করেন। ততদিনে তাঁর সৃজনীশক্তি বিকশিত হচ্ছে নূতন সংস্কৃত কাব্য
রচনায়। মূলাজোড় কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত শিবচন্দ্র সার্বভৌম ছিলেন তাঁর
ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষক। স্বভাবতই এই ছাত্রের সুতীব্র জ্ঞানপিপাসা তাঁকে মুগ্ধ করে।
সংস্কৃত ভাষার তর্কতীর্থ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করার পরে কালীপদকে
“তর্কাচার্য” উপাধি প্রদান করেন অধ্যক্ষ সার্বভৌম। ছাত্র থাকাকালীনই সংস্কৃত ভাষায়
বেশ কিছু কাব্যপ্রকাশনা করেন কালীপদ, যা তৎকালীন সময়ে
ব্যতিক্রমী কৃতিত্ব বলে গণ্য হয়েছিল।
|
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা |
উপাধি প্রাপ্তির পরে কালীপদর পরিচিতি বৃদ্ধি হতে
থাকে। অল্প বয়স থেকেই অভিনয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর। মূলাজোড় সংস্কৃত কলেজের ছাত্র
থাকাকালীন তিনি রচনা করেন সংস্কৃত নাটক নল-দময়ন্তীয়ম্। সেটি ছাত্রদের দ্বারা সফল
ভাবে অভিনীত হয়, এবং নাট্যকার রূপে প্রশংসিত হন তিনি। সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যের অনুরাগীদের
সাথে আলাপ আলোচনা তাঁকে বৃহত্তর জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কলকাতার সংস্কৃত
সাহিত্য পরিষদে একটি শিক্ষক পদ খালি হলে কালীপদ তাতে যোগদান করেন। পরিষদের সাহিত্য
পত্রিকার সহ সম্পাদক হিসাবে আরো কিছু
মৌলিক সংস্কৃত লেখা এই সময়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতার সরকারি সংস্কৃত
কলেজে অধ্যাপক হিসাবে নির্বাচিত হন। শুরু হয় বৃহত্তর ভাবে সংস্কৃত সাধনা, ন্যায় শাস্ত্রের গবেষণা এবং উৎসাহী ছাত্রদের শিক্ষাদান। কর্মজীবনের
পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের ন্যায় বিষয়ের বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন তিনি। মৌলিক
রচনা এবং অনুবাদের নানান গবেষণামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন কালীপদ। ন্যায় শাস্ত্রের উপর
তাঁর প্রকাশনাগুলি হিন্দু দর্শনের গভীর সুচিন্তিত অনুধাবন। তাঁর সামগ্রিক
সাহিত্যকর্ম মূলতঃ তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: (১) অনুবাদ, (২)
মৌলিক কাব্য ও নাট্য এবং (৩) ন্যায় দর্শন টীকা। অনুবাদ সাহিত্যের প্রথমেই থাকবে
রবীন্দ্র কাব্য। রবীন্দ্র সাহিত্যের পরম অনুরাগী ছিলেন কালীপদ। যদিও একথা আজ জানা
যায় না সত্যিই কখনো রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিলো কিনা, কিন্তু অনুমান করা যায় রবীন্দ্র সহচর সংস্কৃতজ্ঞ শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের
সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল। পরম আনন্দে তিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি সম্পূর্ণ অনুবাদ
করেন দেবভাষায়। সে এক বিশাল সাহিত্যকর্ম। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ এই অনুবাদ
গ্রন্থের প্রকাশ করে ১৯৬৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী কাব্যের বাণীকে সংস্কৃতের
সুকোমল শব্দে ছন্দে বদ্ধ করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র
জন্মশতবার্ষিকী উৎসবের সময় সাহিত্য আকাদেমি সংস্কৃতপ্রতিভা শীর্ষক একটি পত্রিকা
প্রকাশনার উদ্দেশ্যে তাঁকে একটি
রবীন্দ্ররচনার সংস্কৃত রূপান্তরের অনুরোধ করেন। এই সময়ের আগে তিনি অনুবাদ করেছেন
রবীন্দ্রনাথের কবিতা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, দেবতার গ্রাস,
বিদায় অভিশাপ, গান্ধারীর আবেদন, দুই পাখি, পরিশোধ, বৃষ্টি পড়ে
টাপুর টুপুর, ইত্যাদি। জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে তিনি
অনুবাদ করেন “পুরস্কার” কবিতাটি। সম্ভবতঃ রসিক সমাজের কাছে সংস্কৃত অনুবাদের
জনপ্রিয়তা তাঁকে এই কাজে আরো উদ্বুদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অনুবাদ
করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত এবং মদন
মোহন তর্কালংকারের রচনা।
|
গীতাঞ্জলির সংস্কৃত অনুবাদ (প্রচ্ছদ) |
তাঁর কৃত মৌলিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে চারটি
বিশিষ্ট কাব্য (১) মন্দাক্রান্তা বৃত্তম্
(২) সত্যানুভাবম (৩) যোগীভক্ত
চরিতম্ এবং (৪) আলোকতিমির বৈরম্। আরো উল্লেখ করা যায় অমিত্রাক্ষর ছন্দে
শ্রীশ্রীচণ্ডী ও শ্রীমদ্ভাগবত গীতা-র বঙ্গানুবাদ। সম্পূর্ণ মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত বিয়োগান্তক খণ্ডকাব্য
মন্দাক্রান্তা বৃত্তম্-এর বিষয়বস্তু তাঁর অকালমৃতা প্রথম পত্নী রাধালক্ষ্মী দেবীর
স্মৃতিরক্ষা। তাঁর জীবনের কিছু ছবির সন্ধান মেলে এই লেখায়। কালীপদর সম্পাদনায় এবং
একক প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হতো সংস্কৃত পদ্যবাণী পত্রিকা। স্বল্পায়ু এই পত্রিকাতেই
ধারাবাহিক রূপে প্রকাশিত হয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সংস্কৃত জীবনগাথা
আশুতোষাবদানম্। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই কাব্যগাথাটি কালের স্রোতে লুপ্ত হয়েছে। তাঁর
লেখা মৌলিক নাটকগুলি হলো: (১) প্রশান্ত রত্নাকরম, (২)
স্যামন্তকোদ্ধার ব্যায়োগঃ এবং (৩) মানবক গৌরবাম্। কলকাতা সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের
উদ্যোগে এই সংস্কৃত নাটকগুলির অভিনয় হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ন্যায় গ্রন্থের মধ্যে
প্রথমেই নাম করতে হয়, অক্ষপাদদর্শনাম্ (১৯৭৫)। এর বিষয়বস্তু
তত্ত্বজ্ঞানের সাথে মুক্তির সম্পর্ক উন্মোচন। সংস্কৃত কলেজ প্রকাশিত নব্যন্যায়ভাষ্যপ্রদীপ
(১৯৭৩) গ্রন্থটি ধর্মতত্ত্বের দুরূহ কিছু বিভাগের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
প্রশস্তপাদভাষ্যের টীকায় রয়েছে বৈশেষিক দার্শনিকদের ধারণায় তত্ত্বজ্ঞানের প্রকৃতি
এবং আরও নানান দার্শনিক বিষয় যেমন গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ এদের বিশ্লেষণ। ভারতীয়
দর্শন প্রচলিত এবং অপ্রচলিত ধারণার সাথে সম্পৃক্ত করে জগতের ব্যাখ্যা তৈরী করেছে।
প্রতিটি দার্শনিক তত্ত্বের সাথে যুক্ত আছে সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন, এবং জগতের সাথে সেই প্রশ্নকে সংযুক্ত করে তার উত্তর প্রদান। তর্কাচার্য সেই
ধারনাগুলিকে সংবলিত করেছেন দর্শন সংক্রান্ত তাঁর নানান ভাষ্যে। সে কাজ যতটাই
জ্ঞানগর্ভ, ততটাই গভীর ভাবনা ও মননের। ন্যায় সম্পর্কিত
অন্যান্য টীকা গ্রন্থগুলি হলো: তর্কশাস্ত্রগ্রন্থাবলী জাতিবাধকবিচারঃ, মুক্তিলক্ষ্মী, মুক্তিদীপিকা, রত্নলক্ষ্মী,
সুপ্রভা, ন্যায়পরিভাষা, প্রবচনত্রয়ী,
তত্ত্বচিন্তমণিদীধিতিপ্রকাশ টীকা, তর্কপ্রকরণম্
এবং মুক্তিবাদবিচারঃ টীকা। অবসর গ্রহনের পরে কর্মস্থল কলকাতা সংস্কৃত কলেজেই মহাচাৰ্য অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে আমৃত্যু কাজ করেন।
|
শ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ |
কলেজে কর্মজীবনের সময় বাগবাজারের নিবেদিতা লেন এবং ওই অঞ্চলের আরো কয়েকটি জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তাঁর পরিবার। অবসর গ্রহনের পরে ১৯৫৪ সালে উত্তরপাড়ার ভদ্রকালীতে নিজের বাড়ি তৈরী করে চলে আসেন। আমৃত্যু এই বাড়িতেই থেকেছেন তর্কাচার্য। স্বর্গীয় শ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ছিলেন তাঁর
বন্ধুস্থানীয়। পরস্পরের মধ্যে ছিল এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ। কথিত আছে, ওঙ্কারনাথের
এক সংবর্ধনা সভায় তিনি উপস্থিত হলে ওঙ্কারনাথ উদ্যোক্তাদের বলেন
তাঁদের দুজনকে একপ্রকারের আসনে বসতে দিতে হবে। নইলে তিনি সংবর্ধনা গ্রহন করতে
অপারগ। প্রথমা
স্ত্রী রাধালক্ষ্মী দেবীর দুরারোগ্য গুটিবসন্ত রোগে অকালমৃত্যুর পরে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন সুশীলা দেবীকে। তাঁর
সাত পুত্রকন্যা। এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠপুত্র গঙ্গেশ চক্রবর্তী বিদ্যাসাগর কলেজের
গণিতের অধ্যাপক ছিলেন, কনিষ্ঠ পুত্র সোমেশ চক্রবর্তী ছিলেন
উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন কলেজের রসায়নের অধ্যাপক। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বার
বার নানান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কালীপদ। ১৯৪১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে
“মহামহোপাধ্যায়” উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬১ সালে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁকে প্রদান করেন মানপত্র। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২ সালে দেয়
সাম্মানিক ডক্টরেট। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের অধ্যাপক
বিমলকৃষ্ণ মতিলাল (১৯৩৫–১৯৯১) এবং পুরাণ বিদ্যার গবেষক ও লেখক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ছিলেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে বিমলকৃষ্ণের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা প্রফেসর ড্যানিয়েল ইংগল্স (১৯১৬–১৯৯৯)। ইংগল্স-এর বই Materials for the Study of Navya Nayaya Logic হলো যুক্তিবাদের এক স্তম্ভ বিশেষ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১ কলকাতায় কালীপদ তর্কাচার্যের সাথে একযোগে নব্য-ন্যায় অধ্যয়ন করেন ইংগল্স। তাঁদের বন্ধুত্বের সূত্রেই বিমলকৃষ্ণের সাথে পরিচয় হয় ইংগল্স-এর। এছাড়াও তাঁর অন্য ছাত্রেরা ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর
নানান প্রান্তে। ১৯৭২ সালের ২৭শে জুলাই পরলোকগমন করেন এই অসাধারণ পণ্ডিতপ্রবর।
ভারতবর্ষে ধ্রুপদী সংস্কৃত চর্চার ধারাটি যতদিন বহমান থাকবে, ততদিন অক্ষুন্ন থাকবে এই বিদ্যোৎসাহী মানুষটির নাম। নিরহংকার দীর্ঘজীবী
মানুষটি দেবভাষায় জ্ঞানপ্রসারের জন্য তাঁর সারা জীবন ব্যয় করেছেন। মনে হয় এই ছিল
তাঁর জীবনদেবতার তপস্যা। রবীন্দ্রনাথের রচনা অনুবাদের প্রসঙ্গে তিনি নিজেকে তুলনা
করেছেন “বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়া” বলে। এমন অকুন্ঠ আত্মবিশ্লেষণ তাঁর মতো
প্রকাণ্ড জ্ঞানবৃদ্ধকেই মানায়।...........................
|
গীতাঞ্জলির একটি অনুবাদ পৃষ্ঠা: যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই |
|
রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের হাতে মানপত্র গ্রহন |
|
ড্যানিয়েল ইংগল্স-এর ১৯৫১ সালে প্রকাশিত বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা এবং কৃতজ্ঞতা পত্র। |
তথ্য ঋণ :
1. শ্রী সোমেশ চক্রবর্তী
2. শ্রী দেবকুমার ভট্টাচার্য
3. The Great Pandits: Twentieth Century Bengal's Contribution to Classical Indian Philosophy (Dept. of Higher Education, Govt. of West Bengal)
4. Sanskrit language (on Britannica) - https://www.britannica.com/topic/Sanskrit-language
5. https://robbar.in/daily-update/an-article-about-bimalkrishna-matilal-on-his-birth-anniversary-by-abdul-kafi/
6. https://en.wikipedia.org/wiki/Daniel_H._H._Ingalls_Sr.
চিত্র ঋণ :
1. শ্রী সোমেশ চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ
2. সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের ওয়েবসাইট
3. গীতাঞ্জলি সংস্কৃত অনুবাদের প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ (পুনঃপ্রকাশ ২০১৫)
ধন্যবাদ শুভদীপ, তোমার এই লেখার মাধ্যমে এক অচেনা-অজানা কৃতী মানুষকে জানতে পারলাম। দুটি প্রশ্ন, সত্যি কী বাংলার ধর্মসাধনার সর্বোৎকৃষ্ট ফল শ্রীরামকৃষ্ণ? দ্বিতীয়, আজকের হিন্দু ধর্ম কী তথাকথিত সনাতন ধর্মের একটি আধুনিক রূপ?
ReplyDelete- প্রসেনজিৎ
ধন্যবাদ, প্রসেনজিৎI আমি তো মনে করি বাংলার ধর্মসাধনার সর্বোৎকৃষ্ট ফল শ্রীরামকৃষ্ণI তাঁর ধর্মসাধনার একটি সর্বত্রগামী বহুমুখী রূপ আছে, যা তাঁর শিষ্য বিবেকানন্দের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় নাI অন্যদের মধ্যে তো নয়ইI সনাতন অথবা আজকের বিজেপি প্রণোদিত হিন্দুত্ব দুটিই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে রূপI ভারতের মাটিতে পুষ্ট হিন্দু ধর্ম তো শ্রীরামকৃষ্ণের মতোই সর্বত্রগামী বহুমুখীI ভারতীয় জনতা পার্টি তার অসত্য রূপ তৈরী করলেও আসল জায়গায়, মনের মাঝে সে খাঁটিI
Delete