পরিচয়ের সংবাদ: শ্রী সুজয় বিশ্বাস (১৯৩৯—২০২১)

পিতৃসম ব্যক্তিকে কি কেউ দাদা বলে ডাকতে পারে? শুনতে অদ্ভুত এই প্রশ্ন এসেছিল আমার মনে, সেই ২০০৫ সালে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের কলকাতা আপিসে সুহাস তালুকদারের কাছে পরীক্ষায় পাস করে সাংবাদিক হওয়ার জন্য মনোনীত হই। প্রথমে কথা হয়েছিল আমাকে যেতে হবে মালদা। উত্তরবঙ্গ সংবাদ ওখানে নতুন একটি দৈনিক পত্রের পরিকল্পনা করছিলো। কথাবার্তার পর স্থির হলো, মালদার সংবাদপত্র শুরু হবার আগে আমি কিছু মাস থাকবো বর্ধমানে। ওখানে এই প্রতিষ্ঠানের অন্য একটি সংবাদপত্র চলছিলো, নাম "সংবাদ"। সেখানেই চলবে আমার সাংবাদিকতার প্রাথমিক শিক্ষা। কথামত আমার বালির বাড়ি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে মার্চ মাসের এক বিকেলে হাজির হলাম বর্ধমানে। মন ভর্তি অজানা আশঙ্কা। বাঙালি গৃহমুখী ছেলের প্রথম বাড়ি থেকে দূরে থাকাপারবো তো সবকিছু সামলাতে?

কাজটা কঠিন থেকে সহজের পথেই চললো। প্রথম দিনেই পরিচয় হলো যাদের সাথে, তারা আমার অচেনা হলেও মোটেই মুখ ঘুরিয়ে থাকার মানুষ নয়। আলাপ চললো দ্রুত গতিতে। শুনলাম, এই আপিসটির প্রধান সুজয় বিশ্বাস বুধবারের ছুটিতে বাড়িতে গেছেন। ওখানেই জানলাম যে সংবাদপত্রে শুধুমাত্র রবিবারের ছুটি হয় না। এক একজনের ছুটি হয় এক এক দিনে। নয়তো রবিবারের খবর তৈরি হবে কি করে? কানাঘুঁসোয় আরও শুনলাম যে সুজয় বিশ্বাস রীতিমত কড়া ধাঁচের মানুষ। বেশ কিছু ছেলে, মানে আমারই মত নব্য সাংবাদিক, তাঁর কাছে বেজায় ধমকধামক খেয়েছে। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা জিইয়ে রইলো। আমার ওপরেও যদি চোটপাট করেন? আমি তো ওদের মধ্যে একেবারেই নতুন, কাজেই অপটু।

বর্ধমানে আমাদের থাকার জায়গা ছিলো নিবেদিতা পল্লীর এক মেসবাড়ি। দোতলা দিব্যি সুন্দর ছিমছাম এক বাড়ি, সামনে ফুলের বাগান। ওপরে থাকেন বাড়িউলি মাসিমা, তাঁর ছেলে আর বউ। আর নিচে আমরা একপাল ছেলে। এই বাড়িতেই সুজয় বাবুর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। গায়ে লাগা তিনখানি ঘর; সেখানে সার সার কাঠের চৌকি পাতা। প্রত্যেকের জন্য এক একটি নির্দিষ্ট জায়গা। আমার জন্য যে খাটটি ঠিক হলো, সেটি সুজয় বাবুর ঘরে। সেখানে তিনটি চৌকি। একটিতে সুজয় বাবু, আর একটিতে আমি। অপরটি খালি। সম্ভবতঃ আপিসের ওপরতলার বাবুর সাথে আর কেউ থাকতে চায়নি, ভয়ে বা সমীহে। কিন্তু আমি তো নতুন। কোনো কিছু না জেনেই আমার থাকার জায়গা ঠিক হয়ে গেল।

খবরের কাগজে সন্ধে বেলার আপিস। আমি বিকেল বেলার ঘুম সেরে উঠতেই দেখি আমার ঘরে এক ভদ্র দর্শন প্রবীণ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন। মাথার ওপরে চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। বুঝতে দেরি হলো না ইনি কে। নমস্কার জানিয়ে বললাম আমার নাম। তিনিও প্রতি নমস্কার করলেন, এবং আমাকে বললেন, "আপনি বুঝি নতুন এসেছেন? কোথায় আপনার বাড়ি?" পশ্চিমবঙ্গে বয়সে বেশ খানিকটা বড়োরা ছোটদের তুমি সম্বোধন করে। অন্ততঃ আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন এই রীতিই প্রচলিত ছিলো। আমার ইস্কুল কলেজের শিক্ষক শিক্ষিকারা তো "তুই" অথবা "তুমি" বলেই আমাদের ডেকে এসেছেন। তাই এই "আপনি" সম্বোধনটা বেশ একটু অবাক করেছিলো। নিজেকে ঠিক "আপনি"র মত সম্মানীয় মনে করিনি তখনো। ওনাকে ভদ্রভাবে বললাম, "আপনি আমাকে তুমি বলুন।" কিন্তু উত্তর এলো স্পষ্ট, "না, আমি কর্মস্থলে সকলকে আপনি বলেই ডাকি।" এর পরে আর অনুরোধ করা চলে না। কর্মজগতের এই প্রথম "আপনি" হওয়ার উপযোগটি ঘটলো, এবং তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম ধীরে ধীরে।

সুজয় বাবু আপিস যেতেন দিনের বেলায়। সম্ভবতঃ বারোটা অথবা দুটো থেকে শুরু হতো তাঁর কাজ। আমাদের বেশির ভাগের কাজ থাকতো সন্ধ্যা সাতটার শিফটে; তারপর রাত অবধি পাতার পর পাতার কাজ চলতো। ফাইনাল প্রিন্ট দেবার আগে টিভির খবর চালিয়ে দেখে নেওয়া হতো শেষ মুহূর্তে কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটে গেছে কিনা। সুজয় বাবু মেসে চলে আসতেন রাত নটার মধ্যেই, অর্থাৎ আমাদের সকলের আগে। আমরা যারা সাতটার শিফটে কাজ সেরে রাত দুটোয় বাড়ি ফিরতাম, দেখতাম সুজয় বাবু মশারি টাঙিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। দরজাটা ভেজানো আছে। এদিকে রাত দুটোয় ফিরলে কি হবে, এই একপাল ছেলের চোখে তখনও ঘুমের মাসি পিসির প্রলেপ পড়তো না। জামাকাপড় ছেড়ে, মুখ হাত ধুয়ে, একচোট গালগল্পে মত্ত হতাম সবাই। আর সেই গল্প কি রেখেঢেকে হয়? এক দঙ্গল তরুণ কি গলা নামিয়ে খোশগল্প চালাতে পারে? মাঝেমধ্যেই তাতে জুড়ে যেত উচ্চহাস্য, যা থামানোই হতো মুশকিল! একদিন তো রীতিমত গোলযোগ বাঁধলো। পাশের ঘরের ঢালাও বিছানায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আমরা সারাদিনের গল্প জুড়েছি। এক গল্প থেকে অন্য গল্পের স্রোতে চলছে অট্টহাসি। এদিকে পাশের ঘরেই সুজয় বাবু যে ঘুমাচ্ছেন, তাতে খেয়াল নেই কারোর। হঠাৎ সেই ঘরের ভেজানো দরজা খুলে গেল। সুজয় বাবু এই ঘরে ঢুকলেন। চোখে মুখে কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার অসীম বিরক্তি। বলে উঠলেন, "কি অসভ্যতা হচ্ছে? সারা পাড়া ঘুমাচ্ছে, আর আপনারা চিৎকার করে গল্প করছেন? কোনো লজ্জা নেই আপনাদের?" এই আচম্বিত ধমকে জোঁকের মুখে নুন পড়লো। ব্যাস, সব চুপচাপ। কারোর মুখে সাড়াটি নেই। সুড়সুড় করে যে যার বিছানায় শুয়ে পড়লো। অগত্যা আমিও চললাম আমার ঘরে, সুজয় বাবুর পাশের সেই চৌকিতে। তবে এর পরেও গল্প আড্ডা থামেনি আমাদের, যদিও সবই নিচু মৃদু স্বরে। হয়তো সুজয় বাবু শুনেছেন, কিন্তু প্রগলভতা বলে আর কিছু বলেননি কখনো।

সুজয় বাবুর নিজস্ব দায়িত্বে ছিলো পাঁচের পাতা, অর্থাৎ সম্পাদকীয় পাতা। প্রতিদিনের সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন নিজের মন থেকে। প্রায়দিনই দুপুরের দিকে আমিও আপিসে চলে যেতাম। ওই মেসবাড়িতে এই সময় বিশেষ কিছু করারও ছিল না। কাছেই এক দোকান থেকে জলখাবার আর দুপুরের খাবার আসতো। খবরের কাগজ পেতে একযোগে তা খাওয়া হতো। তারপরে আর কি বা করার আছে? কাজেই সুজয় বাবুর কাজ দেখা, আর তা দেখে শেখা ছিল আমার একটি কাজ। সংবাদ আপিসে আসতো নানান সংবাদপত্র। সুজয় বাবু সেগুলি প্রথমে পড়ে নিয়ে সমসাময়িক পরিস্থিতি বিচার করে নিতেন। তারপর শুরু হতো লেখা। প্রুফ করা কাগজের পিছনের সাদা পাতায় দ্রুত গতিতে লিখে চলতেন। সম্পাদকীয় অংশে কতটুকু লেখা লাগবে, সে তো জানা ছিলোই। তবে টাইপ করার পরে প্রয়োজনবোধে আবার ছোট বা বড়ো করে নিতেন। সব কিছুই করতেন অতি পরিচ্ছন্ন ভাবে আর তাড়াতাড়ি। পাঁচের পাতা তৈরি হতে বেশি সময় লাগতো না। সপ্তাহের কোনো একটি দিনে তিনি বাংলা সঙ্গীতের ওপর একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখতেন। এই অংশটি একটু বিশেষভাবে বলার প্রয়োজন আছে। বাংলা গানের পুরনো দিনের শিল্পীদের গায়নশৈলী এবং গানের ধারার ওপর লিখতেন উনি। বেশ গবেষণা মূলক লেখা। তবে, সুজয় বাবু কখনো কোনো সহায়ক বই অথবা পত্রিকা সাথে রাখতেন না। পুরোটাই ছিল স্মৃতিনির্ভর এবং অনর্গল। আঙুরবালা, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী থেকে শুরু করে পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কে. এল. সায়গল, আরও কত গায়কের সাধনার ইতিবৃত্ত লিখে যেতেন। আমি বিস্মিত হতাম। সঙ্গীতের ব্যাপারে অল্প স্বল্প উৎসাহী ছিলাম বলে সে ব্যাপারে প্রশ্নও করতাম। আর তার উত্তর আসতো সাথে সাথে। এই উৎসাহ দেখে তিনি বোধ হয় খুশিও হতেন। আর সেই থেকে শুরু হলো তাঁর সাথে এক ভালোলাগার সম্পর্ক। সমীহ, শ্রদ্ধা সব কিছু মিলে গেছিলো তার সাথে।

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিষয় ছিলো প্রাণীবিজ্ঞান। সুজয় বাবু আমাকে বললেন এই বিষয়ে কাগজে কোনো একটি নিবন্ধ শুরু করতে। স্থির করলাম নানান প্রাণীদের অদ্ভুত জীবন যাপন নিয়ে লিখবো। শনিবারের কাগজে যেখানে বিজ্ঞানের পাতা, সেখানে প্রকাশিত হলো আমার সাপ্তাহিক প্রবন্ধ "প্রাণীজগতের অন্দরমহল"। প্রতিদিনের খবরের কাজের সাথে সাথে খোঁজ নিতে শুরু করলাম নানান প্রাণীর। বইপত্র আর ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে পেলাম বিচিত্র তথ্য। আর তাই রূপ পেলো আমার আমার সাপ্তাহিক কলামে। সুজয় বাবুও এই ব্যাপারে উৎসাহ দিতে লাগলেন। লেখা জমা দেবার দুই তিনদিন আগে থেকেই বলতে থাকতেন, "আপনার লেখাটা কিন্তু জমা করে দেবেন ঠিক সময়ে।" শুধু কি তাই? তাঁর উৎসাহে গ্রন্থ সমালোচনার কাজেও হাত লাগালাম। এই সব তো আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। কাগজের আপিসে আসতো লেখকদের পাঠানো নানান বই। নানান তাদের বিষয়বস্তু। সেসব থেকে খুঁজে নিয়ে আমাকে আমার উপযুক্ত বইটি দিতেন তিনি। পড়ে নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমালোচনার কাগজটি তাঁর হাতে দিতে হতো। ছাপার অক্ষরে নিজের নামটি প্রথম দেখেছি "সংবাদ"এর পাতায়। সে যে কি আনন্দের, তা যেকোনো লেখক মাত্রেই জানেন। কাগজের সংখ্যাটি বাড়িতে নিয়ে এসে পরিবারের লোকজনদের, বন্ধুদের দেখাতাম। আর আমার প্রাপ্ত এই সুযোগটুকুর জন্য একমাত্র ভূমিকা ছিলো সুজয় বাবুর।

সম্পাদকীয় পত্রে, মানে সেই পাঁচের পাতায়, প্রতিদিন নানান লেখকের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। লেখক সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। বই প্রকাশনার সাথে যুক্ত থেকে তা ভালোভাবে বুঝতে পারি। আর "সংবাদ"এর মতো একটি ছোট দৈনিকের জন্য সে তো আরও কঠিন। এই লেখকদের সাথে যোগাযোগ করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল সুজয় বাবুর। নানান সূত্র থেকে বিভিন্ন বিষয়ের মানুষদের সাথে কথা বলে লেখা পাঠাবার অনুরোধ জানাতেন তিনি। এই লেখক সংগ্রহের কাজে আমরা একবার গেলাম শান্তিনিকেতনে। বর্ধমান থেকে বোলপুর খুব দূরের পথ নয়। ট্রেনে করেই যাওয়া হলো। আমাদের রামদা, মানে রামসিংহাসন মাহাতো, ছিলেন সংবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সম্পাদক। তিনিও যোগ দিয়েছিলেন এই যাত্রায়। তিনজনে নানান গল্প করতে করতে কখন পৌঁছে গেলাম বোলপুর স্টেশনে। সেখান থেকে রিক্সায় শান্তিনিকেতন। ওখানে বেশকিছু শিক্ষকের সাথে দেখা করা হলো। সুজয় বাবু তাঁদের জানালেন তিনি কি ধরনের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ চাইছেন। খানিকটা ঘুরে বেড়ানোও হলো। আর খাওয়া দাওয়া তো হলোই। আবার সন্ধ্যার মধ্যেই বর্ধমানে ফিরে এলাম আমরা। লেখক সংগ্রহের ব্যাপারে সুজয় বাবু অনেক সময়েই আমার সাথে পরামর্শ করতেন। তখন কয়েক মাসে আমাদের সম্পর্ক আরও সহজ হয়ে এসেছে। একবার আমার বাবা ডা. তপন কুমার ভট্টাচার্যের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর থেকেও লেখা চাইলেন। যতদূর মনে পড়ে, বাবার স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় দুটি প্রবন্ধ আমাদের দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিলো।

"সংবাদ"এর জীবন ছিলো সহজ, সাধারণ, আটপৌরে। সেখানে মিলেছিল বন্ধুভাগ্য আর সুজয় বাবুর মতো এক স্নেহপ্রবণ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আপাত ভাবে এসবই জীবন ধারণের জন্য জরুরি ছিলো। কিন্তু কিছু মালিন্যও ছিলো, সব কিছুতে সব জায়গাতে যা থেকে যায়। সেসব মনকে বিষন্ন করতো, ক্লান্ত করতো। মনে হতো এসব কিছু ছাড়ার চেষ্টা করলে বেশ হয়। সুজয় বাবু চেষ্টা করতেন আমাকে এক সুস্থ পরিবেশ দিতে, কিন্তু সবকিছু তাঁর হাতেও ছিলো না। আমার বর্ধমানে থাকাকালীন একবার রাতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়ির মানুষেরা এসে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যান। সেসময় বোধহয় প্রায় একমাসের বেশি তিনি আপিসে আসতে পারেননি। শুনতাম তিনি ভালো হয়ে উঠছেন। কিছুদিন পরে আবার কাজে এসে যোগ দিলেন। কিন্তু আপিসের সামগ্রিক পরিবেশ তাঁকেও পীড়া দিতো। একসময় আমাকে একান্তে বললেন, "আপনি নতুন কাজ দেখা শুরু করুন। এই জায়গা আপনার নয়।" আমি বুঝতাম, কেন উনি সেকথা বলছেন। আমিও হাঁপিয়ে উঠছিলাম। মাঝে মেসে না থেকে প্রতিরাত্রে ২.৫০ এর ট্রেন ধরে বর্ধমান থেকে বাড়ি ফিরতাম। ট্রেনের মধ্যেই রাতের স্বল্প ঘুম সারা হতো। ক্লান্ত দেহে ভোরের আলোয় বাড়িতে এসে ঘন্টি বাজাতাম। বাবা এসে দরজা খুলে দিতেন। দুপুরে আবার বর্ধমান রওনা হবার সময় মনে হতো, "আরও কতদিন এভাবে?" সুজয় বাবুকে আমার মনের এই টানাপোড়েনের কথা জানাতাম। কখনো বলতেন না, সব কিছু মেনে নিয়ে এখানেই থেকে যান। বরং ঠিক তার উলটো কথাটি বলতেন। আমার নানান চেষ্টায় উৎসাহ দিতেন। ওনার কাছেও শুনতাম, ওনার জীবনের নানান সংগ্রামের কথা, স্বপ্নভঙ্গের কথা। নানান মানুষের সাথে পরিচয় ওনার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলো। আঘাত পেয়েছিলেন অনেক, কিন্তু তারই মাঝে টিকে থাকার তাগিদটি বজায় রেখেছিলেন। আমার "সংবাদ" ছাড়ার কিছু মাস আগে ওখানে আসে অনন্য। সেও আমার সাংবাদিক বন্ধু হয়ে ওঠে। দুজনে আপিসের বিরাট টেবিলের একধারে পাশাপাশি বসতাম। কাজের ফাঁকে কত গল্প আড্ডা চলতো আমাদের। অনন্যর থাকার জায়গাটি হলো আমার আর সুজয় বাবুর ঘরে সেই তৃতীয় চৌকিতে। অতএব আপিসে আমরা সহকারী, আর মেসে আমরা প্রতিবেশী। আমাদের তিনজনের এক বন্ধুসম সম্পর্ক গড়ে উঠলো। কত বিষয়ের আলোচনা চলতো একসাথে। তিনজনে একই আলোচনায় কাটিয়েছি কত সময়। সে বড়ো সুন্দর দিন।

কিন্তু "সংবাদ" ছাড়ার সময় কাছে চলে আসছিলো। ওখান থেকে চলে যাবার মন তৈরি হয়ে গেছিলো। ডাক এসেছিলো দূরের থেকে। সেই ডাকেই সাড়া দিলাম। পদত্যাগ পত্র জমা করে বাক্স গুছিয়ে ফিরে এলাম নিজের ঠিকানায়। কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লী চলে আসতে হলো। তবে সুজয় বাবুর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমি যে ওখান থেকে ছেড়ে আসতে পেরেছি, এই সংবাদই তাঁকে নিশ্চিন্ত করেছিলো। দিল্লী থেকে ফোনেও কথা হয়েছে তাঁর সাথে। প্রথমবার বাড়ি ফিরে একবার বর্ধমানে গেছিলাম। সুজয় বাবুর সাথে দেখা হলো। আমার গ্রন্থ সমালোচনার কিছু টাকা নেওয়াও বাকি ছিলো। সেসব হিসেব নিকেশ চুকলো। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের হিসেব কখনো নিঃশেষ হয়নি। ২০০৯ সালে আমার বিবাহের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বালিতে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন আমার পরম পছন্দের গানের সংকলন: অবিস্মরণীয় রবীন্দ্র সংগীত। কত পুরনো দিনের শিল্পীদের গান আছে তাতে। সুজয় বাবুর পছন্দ আর আমার ভালোবাসা মিলে গেছে এই সংকলনে। আজ এত বছর পরেও দিল্লীতে বসে সেই গানগুলি শুনি, প্রযুক্তির নতুন মাধ্যমে। কত পুরানো, তবু তো তা অবিস্মরণীয়। আজ সেই মানুষটি সশরীরে নেই, আছে ছায়ায় মায়ায় জড়ানো তাঁর স্মৃতিখানি। কিছুদিন আগেও তো ফোনে কথা হলো। মনে তো হলো না সেই দিন আসন্ন। আমার মনে জেগে থাকুক তাঁর সেই চিরপরিচিত মুখখানি, আর ফোনে সেই সাদর সম্ভাষণ, "চিনতে পারছেন? আমি সুজয় বিশ্বাস বলছি। কেমন আছেন?"

মধুর আলস, মধুর আবেশ,   

মধুর মুখের হাসিটি—

মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে   

বাজিছে মধুর বাঁশিটি ।।


ছবি কৃতজ্ঞতা: সুহিনা বিশ্বাস মজুমদার 




Comments

Popular posts from this blog

মহামহোপাধ্যায় কালীপদ তর্কাচার্য (১৮৮৮‒১৯৭২)

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

দিল্লীর প্রবাস জীবনে রবীন্দ্রনাথ