মফস্বল চর্চা ও খিচুড়ি যোগ

আচ্ছা, মফস্বল মানে ঠিক কি? গ্রাম থেকে শহরের মাঝামাঝি কিছু একটা জায়গা? মানে এমন একটা জায়গা যেখানে অনেক কিছু আছে, আবার অনেক কিছুই নেই? নাকি এভাবেও বলা যায় যে, মফস্বল এমন এক বসতি যেখানে অনেক কিছু থেকেও নেই, আবার না থেকেও আছে কিছু। পাঠক বলবেন এ আবার কেমন ধারা কথা! মফস্বলের অধিবাসীরা শোরগোল শুরু করবেন। তর্ক করে বলবেন, আমাদের যা নেই, তার আমাদের দরকারও নেই। আর কি এমন নেই শুনি? বেশ আছি আমরা সুখে, স্বস্তিতে, আরামে, এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় বেড়িয়ে। আমাদের জীবন যাপনের যা কিছু জরুরী, সব কিছু দিব্যি আছে এই মহল্লায়। দোকানপাট আছে, ইস্কুল আছে, পায়ে চলার রাস্তা আছে, শহরে যাবার যানবাহন আছে। কোন অকালকুষ্মান্ড বরাহনন্দন বলে যে মফস্বল পিছিয়ে পড়া জায়গা? যার কিচ্ছু নেই, আর ভেতরটা এক্কেবারে ফাঁকা, ঢনঢনে, সেই বলবে এমন অন্তঃসারশূন্য কথা! আসলে এই জোরের কথাই মফস্বল সম্ভোগ সুখ। জীবনের সব কিছুতে মোটা আন্ডারলাইন টেনে এখানে চলে জীবন চর্চা, বলতে পারি মফস্বল চর্চা। কেমন করে, সেকথা বলবো বলেই তো এই কলমে ধার দিয়েছি।

আমার জন্ম এবং তার পরের কয়েক দশকের ভাগ পড়েছে বাংলার এক পাতি মফস্বলে। পড়েছি সেখানকার সাধারণ ইস্কুলে, আজন্ম শিখেছি মফস্বলের কায়দা কানুন। কাজেই এই জীবনের রীতিনীতি আমার অনেকটাই জানা। শহর আর গ্রামের মাঝের এই অঞ্চলের সব অলিগলির প্যাঁচ আমার শিরায় শিরায় বাঁধা। আমার তুতো ভাইয়েরা শহুরে কলোনি থেকে এখানে বেড়াতে এসে আমাকে বলতো, তোরা তো গ্রামে থাকিস, মানে গ্রামবাসী। ব্যাপারটার মধ্যে কেন যে একটা হীনমন্যতা ছিল তা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। গ্রামে থাকি তো থাকি, তাতে কার বাবার কি, এ কথা ছুঁড়ে দিতে পারতাম না। কেনো পারতাম না? তার কারণ আমার মফস্বল জীবন। এই জীবনের সব কিছুতে সংকোচ, জড়তা, দ্বিধা। কোনো কথা স্পষ্ট করে বলতে গেলে বাধা, নিজের রাস্তায় হাঁটতে গেলে বাধা, নিজের মনের কথা শুনতে গেলে বাধা, অন্যের কথা নাকচ করলেও বাধা। এখানে সবকিছু হলো পরনির্ভর। 

মফস্বল জীবনের গায়ে ভিজে কাপড়ের মত লেপটে আছে মধ্যবিত্ততা, আর খানিকটা নিজেকে অন্যের থেকে বড়ো করে দেখানোর অভ্যাস। কারোর হাতে একটু বেশি পয়সা, কারোর হাতে একটু কম। কারোর জামা ব্র্যান্ডের, তো কারোর জামা পাড়ার দর্জির। কারোর শাড়ি আদি মোহিনী মোহন, তো কারোর চুড়িদার রেলস্টেশন বাজারের। কারো বাড়ি একতলা কোঠা, তো কারোর হাঁকানো দোতলা। কিন্তু একটা ব্যাপারে সকলে এখানে এক। কেউ কারোর থেকে কম যায় না। ভাবখানা দিয়ে তা দেখিয়ে দেবে সকলে। যার পাতে এই রবিবার চুনো মাছের ওপরে ওঠেনি, সে বলবে পাঁঠার মাংস ভাত ছাড়া দুপুরের খাওয়া তার রোচে না। যার ছেলে একটা পাশ দিয়ে চাকরি খুঁজে জেরবার, সে বলবে ছেলে আমার বিরাট কিছু শুরু করলো বলে। যার মেয়ে হলুদ বাটা আর দুধের সর মেখে মাধুরী দীক্ষিত হবার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, সে বলবে তার মেয়েকে বিয়ে করতে হাজির সব তাবড় ধনীর পুত্তুররা। আশ্চর্যের ব্যাপার এসব যারা বলে, তারা ভাবে না এসব মিথ্যে। কোথাও হয়তো সত্যিই এগুলো মিথ্যে নয়। অপূর্ণতার শরীরে কল্পনার কাঁচুলি পরিয়ে এদের রচনা। এসবকে মিথ্যে বলে ধরা হয় না। এই কথাগুলো মফস্বলের মধ্যবিত্ত জীবনের অঙ্গ। তাই তো জীবনের প্রতিদিনের ঘামের সাথে মিশে আছে এই চিত্রগুলো। 

মফস্বলে কাঁচা রাস্তা খুঁজে পাওয়া বেশ একটু দুরূহ। প্রায় সব রাস্তাই পাকা, কিন্তু তাতে পিচের ভাগ সামান্য না হলেও  সুঁড়কির তুলনায় যৎসামান্য। যেকোনো ভোট আসার আগে রাস্তাগুলোয় পিচের দাগ পড়ে, কিন্তু তা কিছু বছর কাটানোর জন্য নয়। এখানকার পিচ কাটে সাকুল্যে এক বর্ষা। তারপরই তার শোচনীয় অবস্থার শুরুয়াত হয়। প্রথমে বের হয় পিচের কণা। আধো ভাঙা আধো গোটা অবস্থায় কিছুকাল কাটে। তারপর ধীরে ধীরে সেই আলগা আস্তরণটি বেরিয়ে গিয়ে পড়ে থাকে ইঁট আর সুঁড়কি। অতঃপর সুঁড়কির ভঙ্গুর জীবন শেষ হলে পড়ে থাকে বিক্ষিপ্ত ভাঙা ইঁটের টুকরো, যাদের ক্ষমতা অসীম। মফস্বল অধিবাসীরা এই অবস্থা নিয়েই দিব্যি দিনযাপন করে। এক মরশুমের বর্ষায় রাস্তায় যে জল জমে যায়, তার তলায় জেগে থাকা এই টুকরোগুলি। তৈরি করে মারণ কল। একবার পা হড়কালে আর নিস্তার নেই। চটি তো ছিড়বেই, তেমন ভাগ্য না থাকলে হাড়গোড় ভাঙার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এখানকার প্রধান যানবাহন দুচাকাওয়ালা সাইকেল, অথবা তিনচাকাওয়ালা রিক্সা বা ইদানিংকালের টোটো। জীবনে একবারও সাইকেল চালায়নি, এমন মফস্বলি খুঁজে বার করা কষ্টকর। ইস্কুলে অথবা প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়তে গেলে সাইকেল, দোকানহাট করতে গেলে সাইকেল, রেলস্টেশনে যেতে গেলে সাইকেল, বন্ধুর সাথে গুলতানি করতে গেলে সাইকেল, এমনকি মেয়ে ইস্কুলের সামনে দাঁড়াতে গেলেও সঙ্গী সেই সাইকেল। এই বিদ্যেটি এখানে শিখতে হয় বেশ কম বয়সে। কিন্তু একবার শিখে গেলে আর চিন্তা নেই। নিজের কাজ তো আছেই, বাড়ির সকলের ফাইফরমাশেও দিব্যি কাজে আসে। রিক্সা বা টোটো পড়ে থাকে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষের জন্য। এই দুটি যানের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে মফস্বলের কত শত মানুষ। যে পাড়ার গলিতে চার চাকার গাড়ি ঢুকতে অপারগ, সেখানে অনায়াসে মাথা গলিয়ে দেয় রিক্সা আর টোটো। ভাড়া নিয়ে রিক্সাওলা বা টোটোওলার সাথে দেদার ঝগড়া করা যেতে পারে, কখনো গালি বিনিময়ও, কিন্তু এদের বাদ দিয়ে শহরতলীর জীবন এক্কেবারে জল ছাড়া মাছের মতো।

পড়াশোনার কাছাকাছি গল্পে আসি এবার। মফস্বলের ছেলেমেয়েদের কাছে ইস্কুল স্থানীয়, কিন্তু কলেজের পাঠ শহরে। গোটা মফস্বল অঞ্চলে কটিই বা কলেজ আছে? কিন্তু সরকারি আর ইংরিজি ইস্কুল অসংখ্য না হলেও গুনতিতে তেমন কিছু কমও নয়। এই ইস্কুল থেকে কলেজ এমন এক যাত্রা যার আন্দাজ পাওয়া যায় না আগে থেকে। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই তাহলে। যে স্বভাবভীরু ছেলে চুলে নারকেল তেল সেঁটে, ইস্ত্রি না করা জড়ানো শার্ট পরে ইস্কুল আর বাজার দোকানের পাট সেরেছে মফস্বলে, শহরের কলেজ তার কাছে মঙ্গল গ্রহ না হলেও কাছাকাছি কিছু একটা। সেখানে ফিটফাট পোশাক পরে, ইংরেজি বেশি আর বাংলা কম বুলি উড়িয়ে যে ছেলেরা আসে, তার কাছে মফস্বলের ছেলে এক কৌটো নস্যি। এরা ফাজিল আর বাচাল, ওরা ভীরু; এরা চৌখোশ, আর ওরা নিংড়ানো ন্যাতা। এদের কথায় ভড়কে যাওয়ার উপাদান থাকে, আর ওরা দুটোর ওপর তিনটে কথা বলতে গেলে খোঁজে অন্য মফস্বলকে। সব কিছুতে সংকোচ আর সম্মানহানির আশঙ্কা এই শহরে পড়তে আসা ছেলেদের। পাছে লোকে কিছু বলে! মফস্বল জীবন ওদের শেখায় কথার প্রত্যুত্তরে কেবল হাসতে। বোকামি মিশ্রিত সেই হাসি। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সময় লাগে বেশ কয়েকটি বছর, যদ্দিনে কলেজের পাঠ চোকে। ছেলেদের কথা যখন এলো, মেয়েদের প্রসঙ্গই বাদ যায় কেনো। মফস্বলের লাল ফিতের বিনুনি বাঁধা, সাদা শাড়ি আর কেডস পরে ইস্কুলে যাওয়া মেয়েরা অনন্যা। ওরা কটাক্ষ হানতে জানে না, কিন্তু ন্যাদানো, নিংড়ানো এই শহরতলীর ছেলেদের বুকে এমনিই হিল্লোল তুলে যায়। উত্তর ভারতের একই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মত ওরা কখনো নিজেদের ভাই বোন ভাবতে পারে না। ওরা মদনশরে ধরাশায়ী হয় না, কিন্তু ধরা পড়ে ভালোলাগার আবেশ জালে। যার বুকে ওরা ফুলের নরম ছোঁয়া রেখে যায়, সে না পারে বলতে, না পারে ওদের ভুলতে। সে এক না গেলা, না ফেলার অবস্থা। ইস্কুল যাওয়ার পথের ধারে দেখা, টিউশন ক্লাসে পাশাপাশি বসা অথবা এক বাড়ির জানলা খুলে অন্য বাড়ির অন্দর। কখনো চলে সামান্য কিছু হাতে লেখা চিঠির বিনিময়। তাতে বানান ভুল থাকে অজস্র, কিন্তু ভালোবাসার উপাদান থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করাও চলে। দুই গলির সন্ধিতে, অথবা মন্দিরের পাশের অন্ধকারে। সেখানে দুই হাতের ছোঁয়া লাগে, কিন্তু তার বেশি কিছু না। এ সব কিছুতে মিলে মিশে থাকে মফস্বল প্রেমের সুগন্ধ। কটি প্রেমই বা পরিণতি পায়? কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয় না এই প্রেমের আবেশ।

আড্ডা বাঙালি জীবনকে সুখে সম্ভোগে আপ্লুত করে রেখেছে। কত বড়সড় বাঙালি মনীষী আড্ডাকে জীবন যাপনের অঙ্গ করে রেখেছিলেন বলুন তো?  সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান কি ছিল না সেই প্রাচীন আড্ডাতে! গুণীজনেরা তার হিসেব কষতে বসলে পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলবেন। কিন্তু এখন যে আড্ডার পরিচয়টি দিতে যাবো, সে ঠিক তেমনটি আড্ডা নয়। এ এক নির্ভেজাল, অথচ ভেজাল তেলে ভাজা চপ মুড়ির মফস্বলী আড্ডা। প্রথমে আসি পুরুষ প্রধান আড্ডার কথায়। চার দেওয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে সেটি বসে নানান বাড়ির সামনের বারান্দায়, যার পোশাকি নাম রক। রকে বসে, তাই নামকরণ হয়েছে রকের আড্ডা। বেকার থেকে সদ্য চাকরি প্রাপ্ত তরুণ, চুল পেকে যাওয়া অবসরপ্রাপ্ত কেরানী থেকে দুই ছেলেমেয়ের মধ্যবয়স্ক বাপ -- কে নেই তাতে? তবে একটাই ব্যাপার। সমমনস্ক অথবা সমবয়স্ক দলের জন্য আলাদা আলাদা রক, মানে আলাদা আলাদা আড্ডা। যেখানে অফিস ফেরত কেরানী আসে সন্ধ্যায়, সেখানে চাকরি খোঁজা ছেলের দল এসে জোটে সকাল বিকেল। আলোচনা কিছু বিশেষ বিষয়ে নয় -- যা কিছু এবং যেমন পছন্দ। হয়তো কেউ শুরু করলো ফুটবলে তার আগ্রহ দেখিয়ে। বাকিরা যোগ দেবে তাদের ইচ্ছেমত মতামত নিয়ে। ভারত কেনো ফুটবলে এগোতে পারছে না, অথবা ক্রিকেটে বিশ্বকাপ কেনো বার বার ছটকে যাচ্ছে, সে নিয়ে এখানে মত প্রকাশ করতে পারে এবং করবে সবাই। কাউকে ছাড়ান দেওয়া হবে না -- সে শচীন তেন্ডুলকার হোক, অথবা পাড়ার উঠতি ফুটবলার বাঘা। সবাই এখানে আলোচনার তীরে ছিন্নভিন্ন হতে পারে। রাজনীতির আলোচনায় বাঙালি সেই সেকাল থেকে দড়ো। স্বয়ং রবি ঠাকুরও সেকথা ফলাও করে লিখে গেছেন। রকের আড্ডায় বঙ্গসন্তান রাজনীতির খাপ খুলবে না, সে একেবারে পান্তা ভাতে পাস্তার মত। কোন নেতা কেনো, কিভাবে, কোথায়, কবে, মাতব্বরি করে বেড়াচ্ছেন, এবং তার আরও কি কি করা উচিৎ এই নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মুখ খুলবে সব আড্ডাধারিরা। তর্ক হবে, তর্ক থেকে ঝগড়া হবে, ঝগড়া থেকে অভিধান বহির্ভূত শব্দের আদান প্রদান হবে, তবে তা মিটবে। কাবুলিদের মত বন্দুক চলবে না, কিন্তু তর্কের রেশ চলবে সপ্তাহ জুড়ে। তবে শান্তি। আড্ডায় লঘু স্বরও থাকবে কিছু। যেমন পাড়ার কোন মেয়েটি বেশি চুলবুলে হয়ে উঠেছে, কোন ছেলের সাথে তাকে দেখা গেছে রেল লাইনের ধারে, অথবা কোন ছেলের বাপ ঘুষের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে, আর তার ছেলে দেখেছে সাপের পাঁচ পা, এসব স্রোতের মত এসে ঢুকবে আলোচনায়। আজ যে শত্রু, কাল সে আবার বন্ধু হবে। আজ যার সাথে কেউ গলায় গলায়, কাল তার অগোচরে নিন্দার চোরা নালা বইবে। কিন্তু কেউ কারোর থেকে আলাদা হবে না। মফস্বল ভাবতে শেখায় একা একা বাঁচা যায় না, বাঁচতে গেলে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে হয়।

মফস্বলী বধূদের আলোচনা চক্রটি একেবারেই আলাদা রকমের। তারাও বসবে রকে, কিন্তু সেখানে পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ না হলেও অবাঞ্ছিত। সারা দিনের কাজ শেষে, খাওয়া সেরে, ঈষদ দিবানিদ্রা সেরে এখানে জড়ো হওয়া। তার আগেও কিছু কাজ আছে। যেমন বিকেলবেলা গায়ে জল ঢেলে আসতে হবে, কাচানো শাড়ি, পরিপাটি টানটান বাঁধা বিনুনি। মাথায় টিপ তো থাকতেই হবে। নইলেই তো প্রশ্ন উঠবে, কেনো টিপ নেই, মুখখানি কেনো অন্যরকম লাগছে, এসব। এই মেয়েলি আড্ডার বিষয়বস্তুটি মূলতঃ পরচর্চা। পাড়ার এবং বেপাড়ার। কার বাড়িতে কি রান্না হলো, কার পরিবারে খাবার ধরন কি, কে তেল ব্যবহারে কৃপণতা করে, কার ছেলেমেয়ে কি পড়াশোনা করে, অথবা কোথায় কাজ করে, এবং অবশ্যই শাশুড়ি বউয়ের সম্পর্কের হালহকিকত। এখানে আসতে পারে প্রকাশ্য থেকে শয়ন ঘর পর্যন্ত নানান উত্তেজক আলোচনা। এই আড্ডা চক্রটি চলবে সন্ধ্যা হবার আগে পর্যন্ত। সন্ধ্যা হলেই গৃহদেবতার সামনে ধূপ দীপ জ্বালানো, আর বাড়ির পুরুষদের কাজ থেকে ফেরার সময়। তারপরই রান্না, রাতের খাওয়া, ঘরের টুকিটাকি, আর আবার একটা দিনের অবসান।

এই সব নিয়ে মফস্বল জীবন। তার সাথে মিলে মিশে আছে ক্লেদ, হতাশা, দুঃখ, আর কিছু ক্ষেত্রে অপমান। কিন্তু সবার চেয়ে বড়ো হয়ে আছে বেঁচে থাকার চেষ্টা। টিকে থাকার লড়াই। আর ছোট থেকে বড় হবার দুরন্ত আশা। মফস্বলের জলজমা সরু রাস্তা সেখানকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আরও বড়ো রাস্তার খোঁজ করতে। যেখানে বৃষ্টির জল গড়িয়ে চলে সীমাহীন নদীর দিকে। এখানে পাড়ায় পাড়ায় মেয়েরা বিচিত্র সুরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সন্ধ্যায় গান চর্চা করে, আবার জিন্স আর টপ পরে জীবন যুদ্ধের শরিক হয় দিনের আলোতে। এখানে যে ছেলে সন্ধ্যায় রকের আড্ডায়, বিড়ির আঁশটে গন্ধে অশ্রাব্যতার আবেশ তোলে, সেই আবার সকালে ইস্ত্রি করা মাড় দেওয়া জামা পরে স্পর্শ নেয় কর্পোরেটের, অথবা আরও বড়ো কিছুর। এখানে যে শিক্ষক হতাশার মিইয়ে যাওয়া হলুদ আলোয় প্রাইভেট টিউশনের খাতা দেখে, সেই আবার রাত জেগে ফেইসবুকে লিখে ফেলতে পারে আস্ত আস্ত গদ্য। মফস্বল মধ্যবিত্ততার আঁতুড় ভূমি, কিন্তু সেখানেও জন্ম নেয় রাশি রাশি স্বপ্ন আর আশা। অনেক কিছু প্রতিকূল এখানে, আশা আর বাস্তবের মাঝে রয়েছে বিরাট চওড়া পরিখা। কিন্তু এই বাঁচাও মন্দ নয়, অন্ততঃ মফস্বলবাসীরা তাই মনে করতে ভালোবাসেন।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

দিল্লীর প্রবাস জীবনে রবীন্দ্রনাথ

Bengali narrative: What are we known for?