জাগার দিন
***
পঁচিশে বৈশাখ কি আসলে এক প্রথা? এক অকর্মণ্য, হতভাগ্য জাতির বিগত গৌরব মনে করবার দিন? নাকি সত্যিই তা এক স্রষ্টার আবির্ভাবের ক্ষণ? আমাদের ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ার দিন হতো পঁচিশে বৈশাখ। দুপুরে টিফিনের পরে পাঁচতলার হলঘরে অনুষ্ঠান। তাতে থাকতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে আধা অর্থবোধক কিছু গান, কিছু গালভরা কথা, আর বার বার শুনে ক্লিষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু কবিতা। রবি ঠাকুরের একটি ছবিও এককোনে ধূপের ধোঁয়ার আড়ালে বিরাজ করতো। তবে কোথাও ছিল না কোনো সুতীব্র ভালোবাসা, অথবা যে কবির জন্মদিন, তাকে বোঝা অথবা বোঝানোর চেষ্টা। যে কবিকে তত দিনে পেয়েছি গীতবিতানের হলুদ পাতায়, তাকে পেতাম না সেখানে। কেমন যেন মলিন এক আস্তরণ ছিল এইসব অনুষ্ঠানে। এক জীর্ণ, শীর্ণ মধ্যবিত্ত মলিনতা। জোর করে ভালো লাগানোর চেষ্টা, অথবা প্রথা বলে সবকিছু মেনে নেওয়া। ঠিক যেমন করে প্রতিদিন ইস্কুলের প্রার্থনাসভা হয়। তারপর আর এক গণ্ডি পার করে কলেজে যখন পড়ি, তখন পঁচিশে বৈশাখ এলো অন্যভাবে। এই দিনে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। সদনের সামনের খোলা প্রাঙ্গণে শামিয়ানা খাটিয়ে অনুষ্ঠান হতো। ভোরবেলার আলোতে শুরু হতো; চলতো অনেকক্ষণ। তখন ছিলাম স্বাগতালক্ষ্মীর গানে পাগল। ভাবতাম পৌঁছাতে দেরি হলে ওই একটি গান যদি শুনতে না পাই। এমন উদগ্র এক আকাঙ্ক্ষা। আমার ইংরেজির মাস্টারমশাইও ছিলেন তাঁর গানের অনুরাগী। বলতেন, "একদিন স্বাগতা আরও অনেক বড়ো হবে। সুচিত্রা, কণিকা ওদের থেকেও অনেক বড়ো।" ওনার সাথে আমার এই পছন্দ মিলে গেছে শুনে মন ভরে উঠতো। ভাবতাম এমন করে যেন অনেক গান শুনতে পাই সেই মন্দ্র মন্দ্রিত কণ্ঠে। আজ যখন শুনি স্বাগতালক্ষ্মী ক্যান্সারে আক্রান্ত; দীর্ঘ কেশবাস ঝরে গিয়ে এক বিগতযৌবনা মূর্তি, অবাক লাগে তাঁকে দেখে। প্রথম যৌবনে যাঁর গলায় বার বার শুনতাম, "এসেছো প্রেম এসেছো আজ কি মহা সমারোহে" তাঁকে খুঁজে পাইনা আর। তখন অবশ্য গান শোনা এত সুলভ ছিল না। অনেক খুঁজে পেতে প্রিয় শিল্পীর ক্যাসেট সংগ্রহ করতে হতো। আর আমাদের মফস্বল জীবনে সেসব পাওয়া কখনোই সহজ ছিল না। জীবনের গতি ছাড়া আর সহজ ছিল না কিছুই।
Comments
Post a Comment