অনেক
কথাই যাবে জানা আসবে যেদিন তেমন সুদিন,
রইবে
না কেউ কারোর নীচে সবাই যেদিন হবে স্বাধীন।
(জীবনচক্র,
দুঃখহরণ ঠাকুরচক্রবর্তী)
যে
বর্ণময় চরিত্রের কথা লিখবো বলে এই কলম ধরেছি, তাকে বর্ণন করবো আমার সীমিত সামর্থ্যে।
ছোটো থেকে পারিবারিক বৃত্তের মধ্যে সেই মানুষটিকে দেখেছি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে
বুঝেছি সেই মানুষটি আমার চেনা বৃত্তের সবসময়ের বাসিন্দা নন। কাছে থেকে কাউকে দেখার
প্রধান অসুবিধা হলো সম্পূর্ণ ভাবে না দেখা। সে দেখায় ব্যাক্তি মানুষটিকে বোঝার অন্তরায়
হয়, তাতে ত্রুটি থাকে। সেই ব্যক্তির ভিতর যদি বিশেষ কোনো চারিত্রিক গুণাবলী থাকে, তবে
তো এই দেখার কাজটি হয় আরও অসম্পূর্ণ। যাঁকে নিয়ে এই কথাগুলি বলছি, তিনি আমার মাতামহ,
হাওড়া জেলার বর্ষিয়ান শিক্ষক, শ্রী দুঃখহরণ ঠাকুরচক্রবর্তী। তাঁকে আমি বোঝার চেষ্টা
করেছি অনেক পরে, যখন আমি শৈশব, কৈশোরের গণ্ডি পার হয়ে এসেছি।
পারিবারিক
সম্পর্ক সূত্রে আমি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা শর্মিলার পুত্র, অর্থাৎ তাঁর দৌহিত্র। তিনি
আমার দাদু। ছোটো থেকে দাদুকে দেখেছি খানিকটা দূরের মানুষ হিসেবে। যদিও আমি তাঁর পরিবারের
প্রথম তৃতীয় প্রজন্ম, আমার বড়ো হওয়ার বেশিরভাগ দিনগুলি কেটেছে আমার বাবা ঠাকুর্দার
বাড়িতে, আমার পিতৃসম্পর্কের ছত্রছায়ায়। দাদুর সাথে ছোটবেলায় সেই অর্থে আমার দেখা
হয়েছে কমই। আমার ইস্কুল জীবনের বেশ অনেকটা সময় তিনি ছিলেন ডোমজুড়ের একটি বিদ্যালয়ের
প্রধানশিক্ষক। তার সাথে সক্রিয় রাজনীতিক। ছুটির দিনে যখন মামাবাড়িতে বাবা মার সাথে
বেড়াতে গেছি, তখন দাদুকে দেখেছি সদাব্যস্ত। একতলার ঘরে বিরাট বইয়ের আলমারি থেকে বই
নামিয়ে পড়াশোনা করছে, লিখছে, অথবা কারোর সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করছে। আমার বাবার রাজনৈতিক
মত ছিল দাদুর সমধর্মী। কাজেই তাঁদের দুজনের ভিতরও নানান আলোচনা হতে দেখেছি। বিদ্যাচর্চা
এবং রাজনীতি এই পরিধির বাইরে এক স্নেহশীল মাতামহ হিসাবে তাঁকে দেখার সুযোগ আমার তৈরি
হয়নি। কাছাকাছি দেখলেও শৈশবে তাঁর কাছে পৌঁছানোর সুযোগ ঘটেনি আমার। তবে সে দরজা উন্মোচিত
হয়েছে একটু একটু করে, যখন আমি ইস্কুলের উঁচু ক্লাসের দিকে পৌঁছেছি। স্বভাবগতভাবে আমি
ছিলাম পড়ুয়া ধরণের। দাদু আমাদের বালির বাড়িতে এলে মা বলতো, “বাবা, তুমি ওর মাধ্যমিকের
পড়াশোনা একটু দেখে দাও তো।” তখন দাদুর কাছে
বসতাম যেসব পড়া বুঝতে পারিনি, তা ভালো করে বুঝতে। দাদু পড়া বোঝাতো গল্পচ্ছলে। ইতিহাস
থেকে ভূগোল, সাহিত্য থেকে গণিত, সব কিছুতে দেখতাম তাঁর অনায়াস গতি। অতি সচ্ছন্দে আমাকে
বোঝাতো ভুগোলকের পরিমাপ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন, ইংরেজি লিখন থেকে বাংলা সাহিত্য,
সব কিছু। তখন খানিকটা অবাকই হতাম এই ভেবে যে দাদু এত কিছু জানে কি করে।পড়া ভালো হয়েছে
কি খারাপ হয়েছে, সেকথা কখনো বলতো না দাদু। তাঁর পড়ানো, আর আমার শোনা, এর মাঝের আনন্দটুকুই
ছিল তাঁর আর আমার প্রাপ্তি।
দাদুর
লেখার সাথে ঠিক কবে পরিচয় হয়, সেকথা এখন আর মনে নেই। তবে যে লেখাটির কথা বিশেষ ভাবে
মনে পড়ে তা হলো “ভারতীয় চিন্তাধারায় দেবী সরস্বতী”। দাদুর ইস্কুল ঝাঁপড়দহ ডিউক ইনস্টিটিউশনের
বাৎসরিক পত্রিকা “ঊষসী”-তে প্রকাশ হয়েছিলো এই লেখাটি। সরস্বতীর উল্লেখ করা হয়েছে,
বেদের এমন নানান মন্ত্র থেকে দাদু তাঁর বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো। বৈদিক যুগের অম্ভৃণ
ঋষির কন্যা বাক কিভাবে নদী সরস্বতীর সাথে একীভূত হলেন বাগদেবী রূপে, ওই লেখায় ছিল
তার প্রসঙ্গ। বয়স কম দেখে প্রতিটি মন্ত্রের ব্যাখ্যা বুঝতে পারিনি, তবে মনের মধ্যে
একটি চিরস্থায়ী ছাপ রেখেছিলো প্রবন্ধটি। পত্রিকার কপিটি আমার বইএর আলমারিতে যত্ন করে
তুলে রেখেছিলাম। পরবর্তীকালে সময় বিশেষে ওই প্রবন্ধটি আবারও পড়েছি। কিছু লেখা থাকে,
যা আজীবন মনে দাগ রেখে দেয়। দাদুর ওই লেখাটিও ছিল আমার কাছে তেমন।
বিভিন্ন
সময়ে দাদু আমার কাছে কিছু আপাত অদ্ভুত প্রশ্ন উত্থাপন করতো। আমাকে বিপদে ফেলার জন্য
নয়, চিন্তার খোরাক জোগাতে। তখন তো জানতাম না, যে শিক্ষার পরিধি বাড়ে প্রশ্নের মাধ্যমে,
চিন্তার মাধ্যমে, যুক্তির পরে যুক্তি সাজিয়ে। সেসব প্রশ্ন ছিল পাঠ্য বইএর বাইরের জগতের।
কয়েকটি তেমন প্রশ্নের উল্লেখ না করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে না। দাদু হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস
করলো, “আচ্ছা, বলতো শ্রীরামকৃষ্ণ পৈতে পরতেন না কেন? তিনি তো ব্রাহ্মণ সন্তান ছিলেন।”
আমি বললাম, “তাই নাকি? বেলুড়মঠে মন্দিরে ওনার যে মূর্তিখানা আছে তাতে পৈতে নেই?” দাদু
আমাকে বললো খোঁজ নিয়ে দেখতে। রীতিমতো অনুসন্ধান চালিয়ে দেখলাম যে দাদুর কথাই ঠিক।
শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তির গলায় তো পৈতে নেই। আমি তো ভেবে কূলকিনারা পেলাম না, যে কিভাবে
এই ব্রাহ্মণ পুত্রের পৈতেগাছাটি বিস্মৃত হলো। দাদুকে জিজ্ঞেস করতে দাদু বললো আরও খুঁজে
দেখতে। কিন্তু উত্তর পাবো কোথায়? বেশ কয়েক মাস পরে দাদু যখন আবার এসেছে, তখন আমি
স্বীকার করে নিয়েই বললাম, যে এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। অথচ জানার আগ্রহ তো প্রবল।
অতঃপর দাদু উত্তর দিলো, “সাধনার উচ্চস্তরে পৈতের আর প্রয়োজন হয় না।” এমন আরও একটি
প্রশ্নের কথা মনে এলো। দুর্গাপূজা সম্পর্কে কথা হচ্ছিলো। দাদু জিজ্ঞেস করলো, “বাংলাদেশ
তো রামচন্দ্রের বাপের বাড়ি, মামার বাড়ি অথবা শ্বশুরবাড়ি কোনোটাই নয়। তাহলে অকাল
বোধনের এই পুজোটি এই বঙ্গদেশে এত গভীর ভাবে স্থান পেলো কেনো?” আমি তো নিরুত্তর। সত্যিই
এক গুরুতর প্রশ্ন। আমার কোনো উত্তরই সঠিক হলো না। বেশ কিছুদিন পরে দাদুই তার উত্তর
যোগালো। জানলাম, কিভাবে মধ্যযুগের অন্ধকারময় অবস্থায় শাক্তপ্রধান বঙ্গদেশে শক্তিবৃদ্ধির
উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার পূজা শুরু হয়। এসব প্রশ্ন ছিল দাদুর মনেই সঞ্জাত, আর তার উত্তর
খুঁজে নিতো সে নিজেই। এই প্রশ্ন-উত্তরের খেলা তাঁর সাথে সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রা দিত।
নব্বই
এর দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নীরদচন্দ্র চৌধুরীর একটি নিবন্ধ দাদুকে বিচলিত
করেছিলো। নীরদবাবু সেই নিবন্ধে শ্রেষ্ঠ পাঁচ বাঙালির তালিকা তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে
স্থান ছিল না ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। নীরদবাবুর যুক্তি ছিল এই যে বাঙালির চারিত্রিক
দোষগুণের বিচার করলে বিদ্যাসাগর মশাই বাঙালি বলে বিবেচিত হবেন না। অমন নির্ভীক, দৃঢ়চেতা
পুরুষ বঙ্গবাসী হতে পারেন, কিন্তু বাঙালি নন। দাদু আমাদের বাড়িতে এসে নীরদবাবুর যুক্তি
খন্ডন করে বোঝানোর চেষ্টা করতো। দাদুর বক্তব্য ছিল এই যে বিদ্যাসাগর মশাইকে ওই তালিকা
থেকে বাদ দেওয়া গর্হিত অপরাধ। বিদ্যাসাগর বঙ্গজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ। দাদু আমাকে
বলতো, “বামুন সন্তান হয়ে আর কেউ বলতে পেরেছেন যে চার্বাকের ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা
˗ এই বাক্য ভুল? এত বড়ো সাহস আর অন্য কারোর
ছিল?” পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে যে নীরদবাবু এবং দাদু দুজনেই দুজনের যুক্তি থেকে
ঠিক, এবং এক জায়গায় তাঁরা এক, যেখানে তাঁরা বিদ্যাসাগর মশাই এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার
করেছেন।
দাদুকে
চেনার সুবিধা হয়েছে তাঁর সাথে নানান আলোচনার মধ্য দিয়েই, স্নেহের মধ্যে দিয়ে নয়।
দাদু যখন “স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়া জেলা” বইটি লিখছে, সেই সময় নানান তথ্যের সংগ্রহের
জন্য তাঁকে আমাদের বাড়িতে আসতে হতো। বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের থেকে নানান বই সংগ্রহ
করতে হতো, অথবা স্থানীয় কোনো মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজনও হতো। এই সময় রাতে খাবার
টেবিলে বসে দাদুর কাছে শুনতাম স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, হাওড়া জেলার এমন নানান
মানুষের কথা। কি বিচিত্র তাদের জীবন, কি গভীর তাদের ত্যাগ, কি বিপুল তাদের দেশপ্রেম।
দাদুর মুখেই প্রথম শুনি ননীবালা দেবীর কথা। ব্রিটিশ আমলে এই বাল্যবিধবা সধবার বেশে
জেলে বন্দী বিপ্লবীদের তথ্য সরবরাহ করতেন। পরবর্তীকালে ধরা পরে যান, এবং চূড়ান্ত অত্যাচারের
সম্মুখীন হন। কালের পথিক এই সব অখ্যাত মানুষদের জীবনকাহিনী মানুষের সামনে তুলে ধরতে
আনন্দ পেতো দাদু। আমার মনে হতো, দাদু বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে কিছু কাজ করে না কেনো?
তেমন লেখাই তো মানুষকে বেশি টানে। এখন মনে হয়, দাদু সাধারণের ভিতর অসাধারণ মনের সন্ধান
করেছে। হয়তো মানুষের কাছে পরিচিতি বাড়ানো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। অন্য অনেকের সাথে
হাওড়া শরৎ সদনে বইটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম আমিও। ওইদিন উপস্থিত সকলের
সামনে আমাকে সময়োপযোগী একটি কবিতা বলতে হয়েছিল।
দাদুর
অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিলো রবীন্দ্রচর্চা। মার কাছে শুনেছি, তার ছোটবেলায় দাদু গুনগুন
করে গান করতো। আজও তার মনে উজ্জ্বল দাদুর গলায় “আমার মল্লিকা বনে।” আমি যখন সে গান
শিখেছি, দাদুকে গেয়ে শুনিয়েছি। দাদু যখন আমাদের বাড়িতে আসতো, আমি ক্যাসেট চালিয়ে
শোনাতাম নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। আমি গলা খুলে গান করতাম; দাদু বলতো, “অত খালি গলায়
গান করিস না, গলা খারাপ হয়ে যাবে।” কত গানের আমার মত করে তৈরি করা অর্থ তাঁকে বলেছি।
কোনো কিছু শুনতে কখনো অনাগ্রহ দেখিনি তাঁর। তাঁর কাছে শুনেছি কত রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
দাদুর নিজের বোধের সাথে মিলিয়ে তাদের ব্যাখ্যা। এই যেমন মনে পড়ছে “নহ মাতা নহ কন্যা”-তে
নন্দনবাসিনী ঊর্বশীর কথা। কখনো আবার মজা করে বলতো, ঠাকুরবাড়ির লোকেদের জন্মগত পাগলামির
গল্প। রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের উল্টো করে জামা পরা, বাড়ির কাজের ঝিকে
দাঁড় করিয়ে গণিতের, দর্শনের তত্ত্ব বোঝানো এই সব। সেই সময় দাদুর মনে চলছিলো “মহৎ
জীবনের আনাচে-কানাচে” বইটির পরিকল্পনা। দাদুর সাথেই আমার প্রথম শান্তিনিকেতনে যাওয়া।
মা বলেছিলো, “বাবা, তুমি ওকে নিয়ে কদিন ঘুরে এসো না। ওর তো আগে কখনো শান্তিনিকেতন
দেখা হয়নি।” তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। বেশ কয়েকদিন ছিলাম ওখানে, উঠেছিলাম পূর্বপল্লীর
গেস্ট হাউসে। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তখন বর্ষাকাল। হিন্দিভবনের সামনে দিয়ে প্রথম
শান্তিনিকেতন আশ্রমে ঢুকছি। লাল কাঁকড়ের রাস্তা সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা। দাদু উচ্চারণ করলো
“পৃথিবী” কবিতা: “তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে।” দাদু তো ধুতিই
পরেছে সবসময়। আমিও সেদিন আশ্রম দর্শনের আবেগে ধুতি পরেছিলাম। ভিজে লাল মাটির চন্দনের
দাগ লাগলো আমার সাদা ধুতিতে। মাটির তিলকও মাথায় লাগালাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চীনাভবনের
সামনে দিয়ে গৌরপ্রাঙ্গণ, ঘণ্টাতলা, পাঠভবন, আম্রকুঞ্জ, দেবেন্দ্রনাথের ছাতিমতলা, শান্তিনিকেতন
বাড়ি, চোখের সামনে মূর্ত হলো সব। যা ছিল বইএর পাতায়, তার শিহরণ লাগলো চোখের পাতায়।
যেকদিন ছিলাম ওখানে, প্রায় প্রতিদিন যেতাম আশ্রমের ভিতর। যেদিন পাঠভবন ইস্কুল খোলা
থাকতো, সেদিনও আমরা আশ্রম চত্বর ঘুরে আসতাম। দাদুর সৌম্য চেহারা দেখে আশ্রমরক্ষীরা
আমাদের কিছু বলতো না। দূর থেকে দেখতাম হলুদ শাড়ি আর পাজামা পাঞ্জাবি পরে মেয়েরা ছেলেরা
ক্লাস করছে। কোনো কোনো দিন আমরা হেঁটে চলে যেতাম শ্রীনিকেতনে। অনেকটা রাস্তা হলেও পায়ে
হেঁটে যেতে দাদুর কোনো ক্লান্তি ছিলো না। আর যাওয়া আসার পথে কতকিছু আলোচনা চলতো। ওই
সময় আমি পড়ছিলাম লাইব্রেরী থেকে আনা "গোরা" উপন্যাস। সেই সবকিছু এই শান্তিনিকেতন
পর্বকে পূর্ণ করেছিলো। পূর্বপল্লী গেস্ট হাউসের কাঁঠালিচাঁপা গাছের দল বর্ষার ছোঁয়ায়
ছেয়ে থাকতো ফুলে ফুলে। আমরা সারাদিনের হাঁটার ক্লান্তি ভুলে যেতাম প্রতি সন্ধ্যায়
সেই সুবাসের মাঝখানটিতে বসে।
২০১৯
সালের আগস্টে দিল্লীতে আমরা রবীন্দ্রনাথের "নটীর পূজা" নাটকটি অভিনয় করি।
এই নাটকের কাহিনী প্রথম বর্ণিত হয় “কথা ও কাহিনী”-র “পূজারিনি” কবিতায়। সেসময় একদিন
ফোন করে দাদুকে বলি “পূজারিনি” কবিতাটি সম্পর্কে তাঁর মতামত জানাতে। সে প্রস্তাব সানন্দে
গৃহীত হয় এবং আমার হাতে আসে দাদুর অনুলিখিত সেই ছোট্ট প্রবন্ধটি। সাহিত্যের আলোচনা
তাঁকে সব সময় আনন্দ দিতে দেখেছি। তা বোঝাতে, বলতে, শুনতে কখনো কোনো ক্লান্তি দেখিনি।
আমি নতুন কোনো বই পড়ার কথা বললেই দাদু এখনো
বলে, “আমাকে এক কপি পাঠিয়ে দিস তো, আমিও পড়ে দেখবো।” পারিবারিক বিষয়ের আলোচনা কখনো তাঁর সাথে করিনি,
বা তাঁর উৎসাহ দেখিনি কখনো। তাই সেই ক্ষেত্রটিতে তাঁকে জানার বিশেষ সুযোগ আমার ঘটেনি।
কিন্তু নূতনের প্রতি, জানার প্রতি এই যে অদম্য আকর্ষণ, তা আমার সমকালীন সময়ে খুব কম
মানুষের ভিতর দেখেছি।
রাজনীতি
একটি গুরুগম্ভীর বিষয়। কিন্তু তার ভিতরেও লুকিয়ে থাকে কত কি রসিকতা, সরসতা। দাদুর
রাজনৈতিক মত তো সুবিদিত। কত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা
আরও গভীর হয়েছে। সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত থেকে করতে হয়েছে কারাবরণও। আমার রাজনৈতিক
জ্ঞান অথবা বোধ কোনদিক থেকে তাঁর সাথে তুলনীয় নয়। কিন্তু আমি তাঁর কাছে শুনেছি রাজনৈতিক
পরিবেশের নানান গল্প; সেসব উপভোগও করেছি। বিধানসভার অধিবেশনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী
বিধান রায়ের সাথে ইংরেজি বলা নিয়ে বিরোধীনেতা জ্যোতি বাবুর সরস বাক্যালাপ শুনে মজা
পেতাম। দাদু যে সময়ের রাজনীতির সাক্ষী, সে সময় বঙ্গ রাজনীতিতে গুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠিত
হয়ন। পারস্পরিক ঘৃণার প্রচারও শুরু হয়নি।
বিভিন্ন দলের নেতারা পরস্পরের সাথে সৌজন্যের সম্পর্ক বজায় রাখতেন। দাদুর অসীম শ্রদ্ধা
ছিল মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উপর। ১৯৭৭ সালে বাম সরকার স্থাপনের পর কিভাবে ভূমিসংস্কার
নীতি নির্ধারণ হয়, কিভাবে ভূমিহীন কৃষকদের ভূমিবণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়, তা শুনতাম
তাঁর কাছে। বাম রাজনীতির বিরোধী নেতা এবং নেত্রীদের সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলে, আমি
স্বপ্রণোদিত ভাবে নেত্রীর ভুয়সী প্রশংসা শুরু করতাম। আমার শ্লেষপূর্ণ তির্যক মন্তব্য
তাঁর মতের চূড়ান্ত বিরোধী হলেও দাদুকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি। বর্তমানের উত্তাল
রাজনৈতিক সময়ে, মানুষ যেখানে বিরোধী মতকে নস্যাৎ করতে, তীক্ষ্ণ আক্রমণ করতে মহাউৎসাহী,
সেখানে দাদুকে দেখেছি সক্রিয় রাজনীতির একসময়ের অংশ হয়েও রাজনীতিকে রসিকতার সাথেই
গ্রহণ করতে। মতের বিভিন্নতাকে যুক্তির মাধ্যমে আলোচনা করতে দেখেছি, আক্রমণের মাধ্যমে
নয়। তাঁর কাছে এ আমার পরম শিক্ষা।
এই
প্রসঙ্গেই আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। তা হলো দাদুর প্রবল রসবোধ। যাদের এই আশ্চর্য
বোধটি থাকে, তাদের সঙ্গ হয় সদা উপভোগ্য। নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশ না করে যেকোনো মানুষের
সাথে কথা বলার সহজ ক্ষমতা দেখেছি তাঁর মধ্যে। বেথুন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা থেকে
সমাজের দূরবর্তী প্রান্তের লক্ষ্মীদি, আমার কলেজের অন্য ধর্মাবলম্বী সহপাঠী থেকে ইস্কুলের
নিচু ক্লাসের পড়ুয়া, সবার সাথে দাদুকে দেখেছি সহজ ভাবে কথা বলতে। এদের সকলের থেকে
তাদের জীবনরসে জারিত অভিজ্ঞতা জানতে দেখেছি তাঁকে। আমার সাথে বর্তমানের ফোনের আলাপে
তাঁর নানান প্রশ্ন থাকে আমার চার বছরের কন্যার দৈনন্দিন জীবনচর্যা এবং তার মতামত নিয়ে।
তার সাথে নিজের সম্পর্কের একটি শব্দও উদ্ভাবন করেছে দাদু। তাহলো পুতনি, নাতনি নয় কিন্তু।
আমার অনুরোধে সেই পুতনির জন্য একটি কবিতাও লিখে উপহার দিয়েছে।
দাদুর
স্মরণ শক্তি প্রসঙ্গে আলোচনা না করলে তাঁর বহুমুখী গুণাবলীর কথা অসম্পূর্ণ থাকবে। কবিতার
প্রতি ভালোলাগা বৃদ্ধির পর থেকে তাঁর মুখে শুনেছি নানান রবীন্দ্র কবিতার আবৃত্তি। সেকথা
তো আগেই বলেছি। এবার বলবো তাঁর মুখে আচম্বিতে শোনা কিছু লাইন। হঠাৎ করে দাদুর মুখে
একদিন শুনলাম উৎসর্গের কবিতা “তোমারে পাছে সহজে বুঝি/ তাই কি এত লীলার ছল।” রবীন্দ্র
রচনাবলী খুঁজে বার করে পড়লাম লাইনকটি। কি অদ্ভুত বাক্যবন্ধ, কি আশ্চর্য সত্য। “বাহিরে
যবে হাসির ছটা/ ভিতরে থাকে আঁখির জল।” মনে হলো, এমন করে বলা কথা তো দাদুই দেখিয়ে দিলো।
আবার একদিন বইএর আলমারি গোছগাছ করছি। দাদু তখন সেখানে উপস্থিত। আপনমনে বললো ক্ষণিকার
কবিতা “যথাস্থান”: মেহগিনির মঞ্চ জুড়ি/ পঞ্চ হাজার গ্রন্থ। মনে হলো, বই সাজানোর অভ্যাসকে
এমন করে বলা আগে তো কখনো শুনিনি। পড়ে নিয়ে মনে করে রাখলাম লাইন ক'খানি। নানান পরিপ্রেক্ষিতে
এমন কত লাইন যে দাদুর মুখে শুনেছি, তার শেষ নেই। ২০১২ সালের কথা। দিল্লী থেকে বাড়িতে
গিয়ে দাদুর সাথে দেখা করতে গেছি। গেয়ে শোনালাম নতুন শেখা ঋকবেদের মন্ত্র মধুমতী সুক্তম।
দাদু শুনে বললো, বেদের আরও একটি মন্ত্র আছে যাতে আছে ছয় ঋতুর বন্দনা। তখুনি শুনে লিখে
নিলাম সামবেদের সেই মন্ত্রটি: বসন্তায় নমস্তুভ্যাং গ্রীষ্মায় চ নমো নমো। এমন কত মুহূর্ত
রয়েছে যখন দাদুর কাছে নতুন কিছু শিখেছি, মনে রাখার চেষ্টা করেছি। কিছু মনে থেকেছে,
অনেক কিছুই ভুলেছি।
|
Dadu as a priest in Bombay in 1980s |
দাদুর
ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল। যজমানী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হিসাবে
দাদু ছোটবেলাতেই পূজাঅর্চনা শিখেছিল। আমার ছোটবেলায় প্রতি দুর্গা পুজোয় তাঁকে বোম্বে
যেতে দেখেছি পুজো করতে। অন্য অনেক কারণেও পুজোর আসনে পুরোহিত হিসাবে বসতে দেখেছি। কিন্তু
কখনো মনে হয়নি যে মানুষটি চরম ভক্তির অর্ঘ্য নিবেদন করছে। আমাকে একবার বলেছিলো, এই
সব পূজাপাঠ আসলে হলো মানসিক বিরেচন। অর্থাৎ যার মাধ্যমে মনের ময়লা দূর হয়। কমিউনিজম
এবং আস্তিক্যবাদ এই দুটি বিষয়কে আমার পরস্পর বিরোধী বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু কমিউনিস্ট
ভাবাদর্শে বিশ্বাসী বহু মানুষকে দেখেছি পূজার মাধ্যমে মনের শান্তি পেতে। এই ব্যাপারগুলি
বহুকালের লৌকিক আচার রূপে ধরে নিলে বিষয়টিকে বোঝা হয়তো সহজ হয়। এক বছর আগে দাদুর সাথে
যখন দেখা হয়, আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি এক স্পষ্ট প্রশ্ন। জীবনের এই উপান্তে এসে তাঁর
কি মনে হয়, ঈশ্বর কি আছে? দাদু তার ঘরের চৌকিতে বসেছিলো। মাথা নাড়িয়ে স্পষ্ট উত্তর
দিলো, “না, ঈশ্বর নেই। শক্তির অস্থিত্ব আছে, তবে এই জীবন শুধু সত্য।” আবার আমার মনে
এলো কবিতা:
“এ
দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি˗
অন্তরে
নিয়েছি আমি তুলি
এই
মহামন্ত্রখানি,
চরিতার্থ
জীবনের বাণী।”
এই
লেখার শেষ করবো মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে দাদুকে কিভাবে দেখেছি, সেকথা বলে। প্রথমে বলি,
আমার স্বর্গতা দিদিমা ইলা ঠাকুরচক্রবর্তীর কথা। দিদা এবং দাদু ছিল দুই ভিন্ন মেরুর
মানুষ। দাদু যতটাই সংসার যন্ত্রের বাইরের, দিদা ছিল ততটাই সংসারী। দাদু যখন তাঁর রাজনৈতিক
জীবনে ব্যস্ত থেকেছে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে সংসার সামলানো সব কিছু একার হাতে দেখতে
হয়েছে দিদাকে। দাদু দিদাকে কখনো একসাথে বসে কথা বলতে দেখিনি। তবে বিভিন্ন সময়ে দুজনের
পরস্পরের সম্পর্কে সরস অভিব্যক্তি উপভোগ করেছি।একদিনের কথা বলি। দিদা বসে নিজের বাগানের
নারকোল বিক্রি করছে এক ব্যাপারীকে। দাদু সেই ঘটনার উল্লেখ করে আমাদের বলছে, “তোমাদের
দিদা একজন বড়ো বিজনেস ওম্যান।” মৃত্যুর কথায় দাদুকে দেখেছি যতটাই শান্ত, দিদাকে
দেখেছি ততটাই বিচলিত। এই ভালোবাসার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার চিন্তায় দুঃখ পেত আমাদের
আবেগপ্রবণ দিদা।আমার বাবার অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে একেবারে ভেঙে পড়তে দেখেছি তাকে। সেইসময়
দিদা আমাকে যে চিঠিটি লিখেছিলো তা জুড়ে ছিল ভয়ঙ্কর বিচ্ছেদের যন্ত্রনা। অথচ মৃত্যুর
সামনে দাদুকে দেখেছি সমাহিত ভাবে সত্যকে গ্রহণ করতে। আজ বার্ধক্যে পৌঁছে নানান কথায়
তাঁর চোখে জল আসতে দেখি, কিন্তু দিদার মৃত্যুর পরেও তাঁকে দেখেছি শান্তভাবে সবকিছুর
ব্যবস্থা করতে। ভাগ্যকে কখনো কঠোর বলতে শুনিনি তাঁকে, যদিও তাঁর জীবনে এসেছে নানান
ঘাত প্রতিঘাত। নূতনের প্রতি আগ্রহ, জ্ঞানের প্রতি ব্যাকুলতা বার বার তাঁকে উত্তীর্ণ
করেছে সব দুঃখ পারাবার থেকে। কখনো অবরুদ্ধ হতে দেখিনি। কখনো মনে হয়েছে মানুষটি কি আমাদের
পরিচিত এই সংসারের সত্যিই যোগ্য? সে কি সংসারে থেকেও সংসারের বাইরের মানুষ? নানান বিষয়ে
যেমন তর্ক করেছি তাঁর সাথে, শুধু তর্ক করা যায় বলে, তেমনি শিখেছি, জেনেছিও অনেক। তাঁর
নিজের সম্পাদিত পত্রিকা “জনকথা”-র জন্য দাদু অনেক সময় আমাকে বলেছে কোনো লেখা জমা দিতে।
সময়াভাবে তা হয়ে ওঠেনি। আজ তাই আমার এই লেখার অঞ্জলি দিলাম তাঁরই পায়ে।
This video was shot in his house in 2008.
Source: Author
গ্রেটার নয়ডা, ২৫শে
আগস্ট ২০২০
Comments
Post a Comment