দুঃখহরণ ঠাকুরচক্রবর্তী: সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত


প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা ও শিক্ষক দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তীর জন্ম ১৯২৭ সালে (১৩৩৪ সালের ১৩ই অগ্রহায়ণ) কলকাতায়। পিতা চিন্তাহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী এবং মাতা চারুবালা দেবী তাঁর জন্মের সময় থাকতেন উত্তর কলকাতার ৬নং শ্যামপুকুর স্ট্রীটে। এই পরিবারের আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামের ফুল্লশ্রী। চিন্তাহরণ কাজ করতেন কলেজ স্ট্রিটের জীবানন্দ বিদ্যাসাগর প্রেসে। দুঃখহরণের দুই মাস বয়সে তাঁর পরিবার চলে আসেন হাওড়া জেলার ডোমজুড় গ্রামে। ১৯৩২ সালে জন্ম হয় তাঁর ছোটবোন নীলিমার। দুঃখহরণের আট বছর বয়সে মৃত্যু হয় পিতা চিন্তাহরণের। প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন গ্রামের জয়চণ্ডীতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে স্থানীয় ঝাঁপড়দহ ডিউক ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ডোমজুড়ের প্রাক্তন বিধায়ক, কমিউনিস্ট নেতা এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তারাপদ দের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে পড়াকালীনই কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যোগদান করেন। ফলতঃ কিছুকালের জন্য প্রথাগত পড়াশোনা স্থগিত রাখতে হয়। প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে ম্যাট্রিক (১৯৫০) ও ইন্টারমিডিয়েট (১৯৫২) পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে কলকাতার সিঁথি নিবাসী রামরতন চক্রবর্তী ও সুরবালা দেবীর কন্যা ইলার (১৯৩৬--২০১৩) সাথে বিবাহ  হয় তাঁর। ১৯৫৮ সালে কলকাতার মনীন্দ্র চন্দ্র কলেজের ছাত্র হিসাবে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দারিদ্র্য এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও অসীম উদ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যান, এবং বাংলা সাহিত্যে স্পেশাল অনার্স (১৯৫৯) ও ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি. (১৯৬০) পাশ করেন। অনেক পরে ১৯৬৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর দুই কন্যা শর্মিলা ও শর্মিষ্ঠা এবং তিন পুত্র প্রদীপ, সন্দীপ (বাপি) ও রূপেশ (পিনু)।

পিতার মৃত্যুর পরে সংসার প্রতিপালনের ভার পরে অতি অল্প বয়স থেকেই। কর্মজীবন শুরু করেন তাঁর নিজের বিদ্যালয় ডিউক ইনস্টিটিউশনের প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষক হিসাবে। এরপর ডোমজুড়ের নেহেরু বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন। অচিরেই জনপ্রিয় শিক্ষক হিসাবে তাঁর পরিচিতি বাড়ে। ১৯৭১ সালে ঝাঁপড়দহ ডিউক ইনস্টিটিউশনের প্রধানশিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। 

সাম্যবাদী রাজনীতিতে আজীবন বিশ্বাস করেছেন দুঃখহরণ। ১৯৪৬ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ১৯৪৮ সালে নেহেরু সরকার যখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় দুঃখহরণের নামে। ১৯৪৯ সালে রমেশ ভট্টাচার্য ছদ্মনামে আত্মগোপন করেন উত্তর কলকাতার লক্ষ্মী দত্ত লেন, নিবেদিতা লেন, পরেশনাথের মন্দির প্রভৃতি জায়গায়। আরও পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে কারাবরণ করেছেন দুইবার। ডোমজুড় পঞ্চায়েতের প্রধান হিসাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বহু মানুষের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। কমিউনিস্ট পার্টির কাজকে জনসেবা হিসাবে গ্রহণ করেছেন তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে। ১৯৯৮ সালে ব্যক্তিগত কারণে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি আজও।

শিক্ষকতা এবং রাজনীতির বাইরে সারা জীবন বিদ্যাচর্চার সাধনা করেছেন। ইতিহাস থেকে সাহিত্যের নানান প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন, লেখালেখি করেছেন দীর্ঘসময় ধরে। তাঁর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। ডোমজুড় থেকে প্রকাশিত "জনকথা" পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েক বছর। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা আট। অবসর জীবনে তাঁর সর্ববৃহৎ কাজ "স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়া জেলা" গ্রন্থ। ডোমজুড় অঞ্চলের আপামর মানুষ তাঁকে শিক্ষক হিসাবে আজও শ্রদ্ধা করেন এবং "মাষ্টার মশাই" বলে ডেকে থাকেন। জীবনের প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছেও জ্ঞানচর্চার অনির্বাণ দীপটি জ্বালিয়ে রেখেছেন দুঃখহরণ।

প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা
১. স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়া জেলা
২. তেভাগা আন্দোলনে হাওড়া জেলা
৩. রোদের রঙ
৪. পদধ্বনি (কবিতার বই)
৫. মহৎ জীবনের আনাচে-কানাচে
৬. হাওড়া জেলার কুইজ
৭. সমর মুখার্জির জীবন ও সংগ্রাম
৮. সঙ্গীতাঞ্জলী

তথ্যসূত্র: জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী শর্মিলা ভট্টাচার্য

বিদ্যাচর্চার নিভৃত কক্ষে দুঃখহরণ
ছবি: লেখক

Comments

  1. মাস্টারমশাই, আপনার কবিতা পাঠ শুনলাম। খুব ভালো লাগলো। আমার ও আমার পরিবারের তরফ থেকে শুভ বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও প্রণাম নেবেন। সকলে ভালো থাকুন।

    ReplyDelete
  2. আপনার সঙ্গে মিশতে পেরে (বাপী দার বন্ধু)আমি অনুপ্রাণিত ।আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি ।সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

দিল্লীর প্রবাস জীবনে রবীন্দ্রনাথ

Bengali narrative: What are we known for?