ইতিহাসের আলোয়: আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে

সরলা দেবী চৌধুরানী (১৮৭২—১৯৪৫)
রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রার্থনা-সংগীত "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে" আজ বহুশ্রুতI বাঙালির নানা উৎসব অনুষ্ঠানে এই গানটি গীত হয়I রবীন্দ্রনাথের গানের পর্যায় বিভাগে পাশ্চাত্য ধরণে গাওয়া এই গানটিকে ভাঙা গানের পর্যায়ে না ফেললেও এই গানটির পিছনে এক বিশিষ্ট ইতিহাস আছেI এই গানটির সুর সংগ্রাহক রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী চৌধুরানীI মহাত্মা গান্ধীর সাথে পত্র বিনিময়ের সুবাদে সরলা দেবী আজ ভারতের সুধী সমাজের কাছে অপরিচিতা ননI সরলা দেবী রবীন্দ্রনাথের চতুর্থ দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর দ্বিতীয় কন্যাI বেথুন স্কুল এবং কলেজের ছাত্রী সরলার জন্ম ১৮৭২ সালে I অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের থেকে তিনি প্রায় ১১ বছরের ছোটI সরলা দেবীর কাছে রবীন্দ্রনাথ হলেন "রবিমামা"I শৈশব থেকেই সংগীতপ্রেমী এই ভাগ্নির সাথে রবীন্দ্রনাথের স্নেহের সম্পর্ক ছিল I ঠাকুর পরিবারের সব থেকে বড় উৎসব ১১-ই মাঘের ব্রহ্ম উপাসনায় ছোট থেকেই সরলা যোগ দেন রবিমামার গানের দলে I  তাঁর নিজের কথায় "রবিমামা বিলেত থেকে ফেরার পর তিনিই নেতা হলেন I দাদাদের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও নতুন নতুন ব্রহ্মসংগীত রচনা করা, ওস্তাদদের কাছ থেকে সুর নিয়ে সুরভাঙ্গা, নিজের মৌলিক ধারার সুর তখন থেকেই তৈরি করা ও শেখানো – এসবের কর্তা হলেন রবিমামাI" সংগীতে পরম আগ্রহী এই কন্যাকে নানান ভাবে উৎসাহিত করতেন রবীন্দ্রনাথ I নিজের সুরারোপিত ব্রহ্মসংগীতে ইংরেজি কর্ড লাগিয়ে তাকে পিয়ানো সহযোগে গাওয়ানোর অভ্যাস করতে বলতেন সরলাকেI

সরলার মাতা স্বর্ণকুমারী ছিলেন সুশিক্ষিতা – তিনি উপন্যাস রচনা করেছেন এবং সাহিত্য পত্রিকা "ভারতী"-র সম্পাদনা করেছেনI কিন্তু সরলার সংগীত চর্চায় তাঁর পিতা জানকীনাথ ঘোষাল (জাতীয় কংগ্রেসের নেতা) এবং মা স্বর্ণকুমারী কারোরই বিশেষ উৎসাহ ছিল নাI এনিয়ে খানিকটা অনুযোগও করছেন সরলা তাঁর আত্মজীবনীর পাতায়I কিন্তু উৎসাহের প্রাচুর্য আসতো তাঁর ছোট মামার থেকে, "প্রাণের গভীরে আমার যে সুরদেবতা অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁকে নিত্য হবিঃ দানে তাঁর পুষ্টিসাধনা করে তাঁর দ্বারা আমার পুষ্টিবিধানের হোতা হলেন রবিমামাI আমি গানের বাতিকগ্রস্ত ছিলুমI যেখান সেখান থেকে নতুন নতুন গান ও গানের সুর কুড়তুম"I  আরও আছে: "যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্য প্রাণ ব্যাস্ত থাকতো – তাঁর মতো সমজদার আর কেউ ছিল না I যেমন আমি শোনাতুম – অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে এক একখানি নিজের গান রচনা করতেনI "কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ", "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে", "আমার সোনার বাংলা" প্রভৃতি অনেক গান মাঝির কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসানI"

আত্মজীবনীর পাতায় সরলা দেবী বেশ খানিকটা আত্মম্ভরীI তাঁর সংস্কৃত শিক্ষা, সংগীত শিক্ষা, বেথুন কলেজের পাঠ, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং সর্বোপরি পারিবারিক আভিজাত্য তাঁর লেখায় অন্তত তাঁকে বেশ অহংকারী হিসাবে প্রকাশ করেছেI এব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর চূড়ান্ত অমিল আছেI  ১৮৯০ সালে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ পাশ করেন সরলা এবং স্বর্ণপদক লাভ করেনI মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই প্রথমদের ভেতরে পড়েনI  পরবর্তী পদক্ষেপ সংস্কৃততে এমএ পরীক্ষার জন্য তিনি বাড়িতে প্রস্তুত হতে লাগলেনI তাঁর সাথে ভারতী পত্রিকার সম্পাদনার ভারও পড়লো তাঁর হাতেI এইসময় সরলার মনে আসে স্বাধীন জীবিকা অর্জনের ইচ্ছাI পূর্বপরিচিত মহীশূরের মহারানী গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নরসিং আয়েঙ্গার দরবার বক্সীকে চিঠি লিখে তাঁর বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার চাকরি পান সরলাI ঠাকুর পরিবারের প্রধান রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুমতি নিয়ে সরলা খুব সম্ভবত ১৮৯১ সালে মহীশূরের এই বিদ্যালয়টিতে কাজে যোগ দেনI

মহীশূরের মহারানী গার্লস স্কুল (১৮৯০)
মহীশূরের শাসনকর্তা তখন ওয়াদিয়ার রাজারাI ১৮৩১ সালে এই রাজ্যটি ব্রিটিশরা অধিকার করলেও ১৮৮১ সালে ওয়াদিয়ার বংশ আবার এই রাজ্যের অধিকার ফিরে পানI এই সময় মহীশূরের রাজা হন ১৯ বছরের চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারI এই যুবক রাজার সময় মহীশূরের শিক্ষা সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন আসেI মহারাজার উদ্যোগে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি হয়I তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সংগীত এবং কলাবিদ্যার নতুন করে চর্চা শুরু হয় মহীশূরেI শুধু তাই নয়, ১৮৯৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রার খরচ বহন করেন চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারI সরলা জানিয়েছেন তাঁর জীবনের এক সন্ধিক্ষন এই বিদেশবাসI বিদ্যালয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে যোগ দেন তিনিI সংগীতের প্রতি আগ্রহে শিক্ষকতার পাশাপাশি মহারাণী গার্লস স্কুলের সঙ্গীতাচার্যের কাছে বীণা শেখা শুরু করেন তিনিI এই সময়ই সম্ভবত দক্ষিণী শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে সম্পর্ক শুরু হয় তাঁর I সরলা লিখছেন, "প্রত্যেক উৎসবের দিন স্কুলের কোন-না-কোন বড় মেয়ে বা শিক্ষয়িত্রী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতো, হাতে উৎসব-ভোজের কিছু না কিছু নিদর্শন নিয়ে আসতোI মাঝে মাঝে তিন-চারজন একত্রে বসে, বীণা সঙ্গে করে এনে আমায় গান ও বাজনা শুনাতI" মহীশূর তখন পরাধীন ভারতের এক স্বতন্ত্র রাজ্য বলে মহারাজা চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ার রাজ্যের উপযুক্ত এক জাতীয় সংগীতের কথা ভাবেনI  সংগীত রচনার ভার পরে রাজকবি বা
সবাপ্পা শাস্ত্রীর (১৮৪৩১৮৯১) ওপর I মহীশূরের রাজপরিবারের উপাস্য দেবী চামুন্ডাI রাজকবি রচনা করলেন চামুন্ডা বা গৌরীর প্রশস্তি-গান "কায়ো শ্রী গৌরী, করুণা লহরী"I ১৮৮১ সালে রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এই গান প্রথম গাওয়া হয় এবং তারপর থেকে জাতীয় সংগীত হিসাবে মহীশূরে বহুগীত হতে থাকেI  কন্নড় ভাষায় লিখিত এই গানে বহু সংস্কৃত শব্দ আছেI  খুব স্বাভাবিক ভাবেই সরলা তাঁর মহীশূর বাসকালে এই গান শোনেন এবং সুরটি তাঁকে আকৃষ্ট করেI ইতিমধ্যে দুর্ভাগ্যবশতঃ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তিনিI ডাক্তার জানায় ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত মহীশূরে থাকা সমীচীন হবে নাI অগত্যা একবছর কাজ করার পরে কাজে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন তিনিI তাঁর সাথে আসে তাঁর শেখা গানের সংকলন, নিজের এবং রবিমামার জন্যI

আগেই বলা হয়েছে যে ঠাকুর পরিবারে ব্রহ্ম-উপাসনার গানে বিশিষ্ট স্থান ছিল সরলা দেবীরI তিনি নিজেও বেশ কিছু ব্রহ্ম-সংগীত রচনা করেনI ১১-ই মাঘের উপাসনায় বাংলা গানের সাথে নানান সংস্কৃত মন্ত্রেরও পাঠ হতোI রবীন্দ্রনাথ নিজে উপনিষদ এবং ঋগ্বেদ থেকে আহৃত বেশ কিছু মন্ত্রে সুর সংযোজন করেনI সরলা প্রয়োগ করলেন তাঁর নতুন শেখা গান "কায়ো শ্রী গৌরী, করুণা লহরী"-র সুরI ঋগ্বেদের মন্ত্র "সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি"-তে সুর সংযোজিত হলোI দক্ষিণ ভারতের সুর এসে মিলিত হলো পূর্ব ভারতেI তবে বিশিষ্ট সুরকার কখনো মূলগানটি হুবহু ব্যবহার করেন নাI তাতে কিছু পরিবর্তন সাধন করেনI এক্ষেত্রেও তাই হলোI সমবেত সুরে গীত দক্ষিণী সুর "কায়ো শ্রী গৌরী, করুণা লহরী"-তে প্রয়োগ হলো সম্পূর্ণ বিলেতি ধারা হার্মনিরI ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী লিখছেন, "সং গচ্ছধ্বং' সম্বন্ধে একটি গুরুতর বক্তব্য এই যে, সরলা দিদি বরাবরই.... দুই কলির দুই সুর ভিন্ন ভিন্ন দল দিয়ে পরপর অগ্রপশ্চাৎ গায়িয়েছেন, যথা – প্রথমটির নিচের সুর ছেলেদের আগে, উপরের সুর মেয়েদের পরে; দ্বিতীয়টির উপরের সুর মেয়েদের আগে, নিচের সুর ছেলেদের পরে; কিন্তু একসঙ্গে সুর কখনো গাওয়াননি, এবং তা গাইলে দু-এক জায়গায় হার্মনির ব্যাতিক্রমও হতে পারেI" অনুমান করা যায় যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে এই গানটি গাওয়ানো হয়েছেI

রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১—১৯৪১)
উৎসাহী শ্রোতা "কায়ো শ্রী গৌরী, করুণা লহরী" এবং "সং গচ্ছধ্বং" দুটি গান পরপর শুনলে বুঝতে পারবেন যে তাদের মূলগত পার্থক্য অনেকI মূলগানটি নিবদ্ধ যে কর্ণাটকি রাগে তার নাম ধীরাশঙ্করাভারানামI মিল শুধু আছে তাদের কাঠামোয়I সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রকাশিত ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপির প্রথম খন্ডে এই গানটি মুদ্রিত হয়েছে I একতালে সীমাবদ্ধ এই বেদগানের সূচনায় বলা হয়েছে মহিসুরী সুরI আবার সরলা দেবীর আত্মজীবনীতে ফিরে যাইI তিনি লিখছেন, "মহীশূরে যখন গেলুম সেখান থেকে এক অভিনব ফুলে সাজি ভোরে আনলুমI রবিমামার পায়ের তলায় সে গানের সাজিখানি খালি না করা পর্যন্ত, মনে বিরাম নেইI সাজি থেকে এক একখানি সুর তুলে নিলেন তিনি, সেগুলিকে মুগ্ধচিত্তে নিজের কথা দিয়ে নিজের করে নিলেন – তবে আমার পূর্ণ চরিতার্থতা হলোI "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে" .. আমার আনা সুরে বসানো গানI" লক্ষ রাখতে হবে যে সরলা দেবী মহীশূর থেকে ফিরে আসেন ১৮৯২ সালেI খুব সম্ভবত তারপরেই স্থির হলো বেদগানের সুরটিI রবীন্দ্রনাথের সুরলোক থেকে উৎসারিত "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে" গাওয়া হলো ১৮৯৩ সালের মাঘোৎসবেI এবার লক্ষ্য করতে হবে রবীন্দ্রনাথের গানের রূপটিI স্বরলিপি অনুসারে এই গানের রাগ হলো ঝিঁঝিট-মহিসুরি-ভজনI "সং গচ্ছধ্বং" আর রবীন্দ্রনাথ রচিত "আনন্দলোকে" দুটি গানই একতালে নিবদ্ধI "আনন্দলোকে"-র সুর শুনলে এইগানটিকে প্রথমেই মনে হয় কোনো বিলেতি সুরাশ্রিত গানI  অথচ কি আশ্চর্য! এই গানের জন্ম হলো এক দক্ষিণী সুরকে আশ্রয় করে, এক কর্ণাটকি রাগকে ভিত্তি করেI  স্রষ্টা মুলগানের সুরের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন তার আপন মনের মাধুরীI  তাই ভাঙ্গাগান হোক, আর নাই হোক, এই গান হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের একান্ত গানI সরলা দেবী বলছেন, "দিতে তাকেই চায় প্রাণ, যে নিতে জানেI বাড়ির মধ্যে শ্রেষ্ঠ গ্রহীতা ছিলেন রবিমামা, তাই আমার দাত্রিত্ব পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল তাঁতেI" আগ্রহী পাঠকের সুবিধার্থে জানাই যে "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে"-র ত্রয়োদশ লাইনে ব্যবহৃত "ভূমাস্পদ" শব্দটি দক্ষিণী গানটিতেও রয়েছেI আশ্চর্য সমাপতন I গীতিকার তাঁর নিজের রসে গানটি মজিয়ে নিয়েছেন, অথচ মূলগানটির ওইটুকু শব্দে তাঁর আগ্রহ হয়েছেI এমন সমন্বয় বাংলা গানের অন্য কোন সৃষ্টিতে বিরলI

II তথ্য সূত্র II

১. সরলা দেবী, "জীবনের ঝরা পাতা"সুবর্ণরেখা২০০৭.

২. ব্রহ্মসংগীত স্বরলিপিপ্রথম খন্ডসাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রকাশিত

৩. মুলগানের কথা: cbkwgl.wordpress.com / accessed on 19 June 2018

৪. মহীশূরের ইতিহাস: www.karnataka.com / accessed on 19 June 2018

৫. মহীশূরের ইতিহাস: en.wikipedia.org / accessed on 19 June 2018

৬. সরলা দেবীর ফটোগ্রাফ: দার্জিলিঙে অবস্থিত চিত্তরঞ্জন দাসের বাসগৃহ থেকে সংগৃহিত 

৭. Photograph of Maharani's Girls' College, Mysore: This photograph taken in the 1890s by an unknown photographer, is from the Curzon Collection's 'Souvenir of Mysore Album'


Comments

  1. Darun Subhodip, onek tathyo jante parlam. Onek dhanyobad.

    ReplyDelete
  2. Anek ajana tatthya jante parlam. Dhonnobad share korar jonne.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

দিল্লীর প্রবাস জীবনে রবীন্দ্রনাথ

Bengali narrative: What are we known for?