অতীতের আলোতে আমার পঁচিশে বৈশাখ

রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার প্রথম পরিচয় খুব সম্ভবতঃ ইস্কুলের হাত ধরে। প্রথম শ্রেণীতে যখন পড়ি, বার্ষিক অনুষ্ঠানে দেখলাম "নৃত্যের তালে তালে" এই গানটির সাথে সমবেত নাচ। আজ এত বছর পরেও মনে পরে কি সুন্দরই না লেগেছিল সেদিনের অভিনয়। বৃত্তের মাঝখানে নটরাজ আর পার্বতী, আর তাদের সাথে বৃত্তাকারে নাচছে ছোট মেয়েদের দল। কানে যেন পৌঁছালো সেই ধ্বনি, "নম নম নম, তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত, ভরুক্ চিত্ত মম।" প্রতি বছর গরমের ছুটির আগের দিন বিদ্যালয়ের রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান হতো। হয়তো খুবই সাদামাটা নাচ গানের অনুষ্ঠান। তবু কোথায় যেন একটা ভালোলাগা কাজ করতো। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, মা তখন বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের এক বইমেলা থেকে কিনে আনলো এক খন্ড গীতবিতান। খবরের কাগজের মলাট দিয়ে সেই বই তুলে রাখলো বইএর আলমারিতে। কিন্তু আমার হাত পৌঁছে গেলো সেখানে। আমাদের পুরোনো বাড়িতে মার ঘরের সামনে ছিলো এক ছোট্ট লাল মেঝের বারান্দা। মা একদিন দেখলো সেই বই খুলে অঝোরে বেসুরে গান শুরু করেছি আমি। তখন তো আমি পড়তে শিখে গেছি। কিন্তু গীতবিতান থেকে কি পড়লাম আমি? অমন ভাষা পড়ার যোগ্যতাই বা হলো কখন? কি জানি। কিন্তু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মা আমার বাবুইকে (বাবা) বললো ওকে গান শেখানো শুরু করা দরকার। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা না পড়লেও কবির কবিতার ভাষার সাথে পরিচয় কিন্তু হয়েছে আমার। দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকতে পড়েছি সহজ পাঠ তৃতীয় ভাগ। সেই বইয়ের শুরুতে মায়ের সাথে শিশুর ছবি আর সেই চিরকালের কথা, "সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।" তার সাথে পড়লাম আরও কয়েক টি কবিতা আর রাজকন্যা মেঘমালার গল্প। আর হ্যা, সেই বইতে আরও ছিলো, আবদুল মাঝির গল্প। এই সব গল্প, কবিতা আর তার সাথে নন্দলালের চিত্রণ আমাকে হয়তো রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে খানিক আগ্রহী করে তুলেছিল। শুরু হলো গানের শিক্ষা। আমাদের রক্ষণশীল বাড়িতে সেই প্রথম কোনো ছেলে শুরু করলো গানের পাঠ। কলকাতার শরৎ সরদার বলে এক দোকান থেকে গানের মাষ্টারমশাইকে সঙ্গে নিয়ে বাবুই কিনে আনলো হারমোনিয়াম। সা রে গা মা শেখার কিছুকাল পরে আমার খাতায় মাষ্টারমশাই লিখে দিলেন, "আয় তবে সহচরী।" হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমার প্রথম শেখা গান। তার আগে অবশ্য ইস্কুলে রীতা দিদিমনির ক্লাসে গান শিখেছি, পনেরোই আগস্টের আগে। আজ মনে পরে সেই গানটি ছিলো "শুভ কর্ম পথে ধরো নির্ভয় গান।" রীতা দিদিমনির এই বিশেষ ক্লাসটি ছিলো আমার এক আকর্ষণ। দ্বিতীয় শ্রেণীর পরে প্রতি বছর অপেক্ষা করতাম কবে সেই রিহার্সালের দিনগুলো শুরু হবে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তে ওনার কাছে শিখলাম, "হে মোর চিত্ত পূণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে" আর "বুক বেঁধে তুই দাড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই।" কত ভালো করে গানটা তুললাম আমরা। কিন্তু কি কান্ড, বৃষ্টি এসে সেবারের পনেরোই আগস্টের অনুষ্ঠানই ভন্ডুল করে দিলো। কবির সৃষ্টির বিস্তার কিন্তু শুরু হলো, আমার জীবনে, মনে। পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে পড়লাম, "জন গণ মন" গানটির পাঁচটি স্তবক। হয়তো বুঝতে পারলাম না। এক স্তবকের শেষে "প্রেমহার হয় গাঁথা" শুনে হেসে ফেললাম! কিন্তু পরে বুঝলাম, কবির সেই প্রচন্ড বিস্তার চললই। আমাদের বিদ্যালয় শুরুর প্রার্থনাতে ছিলো, "মোরা সত্যের পরে মন", "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে" -- এই সব গান। তার সাথে পর পর শ্রেণীতে চললো তাকে আরো আরো জানা। আজ কি আর সব কথা মনে আছে! কত কবিতা, কত লেখাই তো ভুলে গেছি। নবম শ্রেণীতে উঠে আবার তাকে নতুন করে পেলাম। দিদিভাইয়ের (শ্রীমতী শিপ্রা সরকার) মুখে কবিতা পাঠ শুনে। সুললিত স্বরে দিদিভাই যখন পড়তেন "দীনদান", তখন এই আপাত ছন্দবিহীন কবিতাটি আমার অঙ্গরাগ হলে উঠলো। কি সুন্দর শব্দের প্রয়োগ, সাধারণ মানুষের প্রতি কি গভীর অনুরাগ আর মমত্ব কবির। তাইতো দেবতা রাজার তৈরি মন্দিরে আর থাকতে চান না, যেতে চান সাধারণ মানুষের কাছে। "শিক্ষা" বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধও পড়তে হতো সেই সময়, নাকি তার খানিক দিন পরে একাদশ শ্রেণীতে। সেটি কিন্তু বেশ কঠিন মনে হতো। নবম শ্রেণীতে ওঠার কিছু কাল আগেই আমি গান শেখা ছেড়ে দিই। কারণটা বয়সোচিত। বয়সন্ধিতে গলার পরিবর্তন হতে আমার গান করার অসুবিধা হতে লাগলো। আর সমবয়সী কাউকে দেখতামও না গান শিখতে। তাই মার কাছে প্রস্তাব করলাম আর গান শিখবো না। বাবুই তো খুব বকাবকি করলো, আমি কিন্তু তখন আমার সিদ্ধান্তে অনড়। অতএব মাষ্টারমশাইর আসা বন্ধ হলো। কিন্তু মনের জানালা দিয়ে কবির আসা বন্ধ হলো কি? কই, হলো না তো। নব্বয়ের দশকের শুরুতে বাংলা গানের নতুন দিগন্তের সন্ধান করলেন সুমন। আধুনিক গানের সাথে বেরোলো তার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট -- ভালোবেসে সখী। আমি তার অনুচর হলাম। সময় পেলেই শুনতাম সুমনের গলায়, "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা।" কি পৌরুষ দৃপ্ত কণ্ঠ সেদিন সুমনের। আমার মনে গুঞ্জরিত হত, "তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম বিজন জীবনবিহারী।" আমাদের বাড়িতে নতুন টেপ রেকর্ডার এর সাথে বাবুই নিয়ে এসেছিল এক গুচ্ছ রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট। তা চালিয়ে শুনতাম চন্ডালিকার গান, "শুধু একটি গণ্ডুষ জল, আমার জন্ম জন্মান্তরের কালি ধুয়ে দিল গো।" আমার ছোট্ট ভাইএর জন্য চালাতাম কলকাতার পাঠভবন স্কুলের ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠীর গান, "অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো।" ভাই বলতো, "আবারো ওই গানটা চালা না, দাদাভাই।" এভাবেই চললো তার সাধনা, নাকি শুধু ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাকে পাওয়ার আকাঙ্খা? একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত শরীরে যখন ঘরে ফিরতাম, আমার ঠাকুমা বানাতেন রাজস্থান থেকে সদ্য শেখা উত্বপাম, আর আমি ওপরের ঘরে ছিটকিনি এঁটে চালাতাম, "আমারে করো জীবন দান।" আমার সুখ দুঃখের আসমান জমিনে এভাবে গ্রথিত হলেন কবি। তাকে বুঝবো সে বুদ্ধি কই? কিন্তু ভালোবাসতে তো কোনো বাধা নেই, তার গান শুনে ভালো লাগতে তো কোনো টানাপোড়েন নেই। পড়াশোনার ফাঁকে তখন চেষ্টা করতাম গল্পগুচ্ছের পাতা উল্টাতে, কয়েকটা গল্প পড়ে ফেলতে। কলেজে উঠে স্বাধীনতা আরও কিছুটা বাড়লো। আমার দাদুর সাথে এক সপ্তাহের ছুটিতে গেলাম শান্তিনিকেতন। সাথে করে অর্ধসমাপ্ত "গোরা"। যা পড়েছি লেখায়, যা দেখেছি স্বপ্নে, এবার তাই দেখলাম চোখের সামনে। চিনা ভবনের সামনে লাল মাটির রাস্তা -- দাদু উচ্চারণ করলো, "আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো পৃথিবী"। আমার পায়ের তলায় লাগছে সদ্য বৃষ্টির শেষে লাল মাটির রঙ। সে কি আকুলতা। দেখলাম আম্রকুঞ্জ, মহর্ষির শান্ত সমাহিত বেদি, আর গৌর প্রাঙ্গণ। এখানে সবকিছু কেমন আনন্দময়, অতি গভীর সুরে বাঁধা। তখন তো আর মোবাইল নেই যে ছবি তোলায় ব্যস্ত হবো। তাই মনের গহনে ছবি তুললাম পাঠভবন থেকে সংগীত ভবন, কলা ভবনের। দাদুর সাথে হেঁটে একদিন গেলাম শ্রীনিকেতনে। কি মত্ততা তখন। মাথার ওপরে উদাত্ত নীল আকাশ, আর আমার মনে আসছে কত না গাওয়া গান। উত্তরায়ণ দর্শনে গিয়ে প্রতিটি বাড়ি দেখলাম মুগ্ধ চোখে। এই তো শ্যামলী -- এই তো "কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা।" রোজ রাতে পূর্বপল্লীর যে গেষ্ট হাউসে থাকতাম তার বাগানে কাঁঠালি চাঁপার টুপ টাপ ঝরে পরা দেখতাম। রতন পল্লীর রাস্তায় দেখতাম বইতে পড়া লজ্জাবতী লতা। হাত লাগিয়ে দেখতাম সত্যিই লজ্জায় মুড়ে যায় কিনা। মনে হলো ওখানে সব কিছু অপরূপ। এক সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরে মনে হলো আমার ঘোর লাগা থেকে এবার জেগে উঠলাম। শুরু হলো আবার সেই সব নীরস পড়ার ভার। মা এর মধ্যে বললো, "নানু, তুইও চল না কিটির সাথে গান শিখতে। দেখবি, এখন আবার ঠিক পারবি, কোনো অসুবিধা হবে না।" রাজি হয়ে গেলাম। সেই শুরু হলো। প্রতি সপ্তাহে আবার গানের ক্লাস। নতুন নতুন গানের লেখা আর সুর দিয়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা। তখন তো আমাদের নতুন বাড়িতে মাত্র দুটো ঘর। কলেজ থেকে ফিরে আমি সামনের ঘরের দরজা বন্ধ করে রেওআজ করতে বসতাম। রবীন্দ্রনাথের আলো বাতাস আমাকে স্পর্শ করে যেত। তারপর তো কত পথ পাড়ি দিলাম, কত নতুন মানুষকে চিনলাম, জানলাম, বন্ধুত্ব হলো। কিন্তু ওই যে বন্ধুত্ব হয়েছিল কবির সাথে, আর তার গানের সাথে -- তা আর কখনো ছাড়িনি। যে প্রান্তেই গেছি, সেখানেই আমার বন্ধুত্ব হয়েছে এই এক সম্পর্কের জোরে। আর তার পরিধি আজও বেড়েই চলেছে। আজ এই পঁচিশে বৈশাখ তাই আমার বন্ধুত্বের স্মরণদিন। ইস্কুলের বন্ধুদের সাথে এই দিনটি জুড়ে যে আলো আসা, ভালোবাসা তাই ভাগ করে নিলাম। কথার স্রোতে সেই ভালোবাসা যেন দূরে না চলে যায়; তাহলে তো সবটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই, "ঝর ঝর হলো এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি।"


পঁচিশে বৈশাখ ২০১৯ I দিল্লী
পঁচিশে বৈশাখ ২০১৯ I দিল্লী





পঁচিশে বৈশাখ ২০১৯ I দিল্লী

Comments

Popular posts from this blog

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

দিল্লীর প্রবাস জীবনে রবীন্দ্রনাথ

Bengali narrative: What are we known for?