ছেলেবেলার দোলখেলা

দোল উৎসব শুরু হলো আর শেষও হলো। আমার আপিসে ছুটির দিন কাটলো দিল্লির কাছেই আমাদের এক আবাসনে, বন্ধুদের সাথে গল্পো করে, গান গেয়ে, আর এই সময়ের বিশেষ কিছু খাবার খেয়ে। উত্তর ভারতে হোলির কিছু নির্দিষ্ট খাবার আছে, আমাদের ছোটবেলায় যেমন ছিলো রঙবাহারি মঠ আর ফুটকরাই। এই সময় এখানে তৈরি হয় এক সুস্বাদু মিষ্টি, যার নাম গুজিয়া।  আমাদের সাদা রঙের ছোট্ট গুজিয়া নয় কিন্তু। শুকনো পিঠের মতো একরকমের বড়ো মিষ্টি যার ভিতরে থাকে ক্ষীর, কাজু, কিসমিস, পেস্তা আর নারকোলের পুর। আমার খুব প্রিয় মিষ্টি এই গুজিয়া। আর তার সাথে থাকে নানা রকমের পাকোড়া আর শরবৎ। আর হ্যা, বন্ধুদের সাথে আবির খেলাও হলো, আর আবাসনের নিচে আমার মেয়ের ছোট্ট বন্ধুদের কাছেও মিললো জল মেশানো হালকা রঙের উপহার। 

আমাকে অনেকে ফোনে জিজ্ঞাসা করলেন, "মেয়ে রঙ খেললো? ভয় পায়নি তো?" আমি বললাম, "কই নাতো, সেতো বন্ধুদের সাথে দিব্যি রঙের আনন্দে মাতলো।" আসলে বুঝতে পারি একথা বলার কারণ। আমাদের ছোটবেলায় রঙখেলাটা অনেক সময় এক জান্তব রূপ নিতো। যে মানুষ রঙ খেলতে চাইবে না, তাকে ঘর থেকে টেনে হিচড়ে বার করে জোর করে তার মুখে, চোখে, সারা গায়ে রঙ মাখিয়ে কি জানি এক পাশবিক আনন্দ পাওয়া যেত, বীরত্বের প্রকাশ হতো। যে মাখালো তার হলো আনন্দ, আর যাকে মাখানো হলো সে পেলো ভয়। বাংলা থেকে কর্মসূত্রে দিল্লিতে আসা কত মানুষকে বলতে শুনেছি রঙখেলা নিয়ে তারা কি প্রচন্ড ভয় পায়। শৈশবে রঙের খেলার ওই আনন্দটাই বোঝানো হয়নি যে। বোঝানো হয়নি, স্থলে জলে, বনতলে যে দোল লেগেছে, তাকে শরীরে মনে বরণ করে নাও এখন। 


আমার কর্মজীবনে কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, যারা সত্তর-আশির দশকে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে ইস্কুলের পাঠ নিয়েছে। দেখেছি, কি গভীর শ্রদ্ধার সাথে তারা দোলের সেই আনন্দদিনটি স্মরণ করে। তখনকার ছাত্র-ছাত্রী অধ্যাপকরা মিলে কিভাবে সেই উৎসব পালন করতো সেই গল্পো বলা এখনও তাদের সবথেকে প্রিয় বিষয়। তখনও দোল হয়নি আজকের শান্তিনিকেতনের তাণ্ডবতা পূর্ণ "হ্যাপি হোলি" আর লোলুপ মদ্যপতা। জানিনা, আজ বালিতে কেমন করে দোল হয়, আজকের নতুন প্রজন্ম কেমন করে বসন্তের আগমনকে স্বাগত জানায়। মার কাছে শুনি তেমন করে কেউ আর আসে না। মাও দোলের উপাচার সারে তার দেবতার পায়ে আবিরের অঞ্জলি দিয়ে। আমার এই বাসস্থানের চারপাশে বসন্ত কিন্তু আসে তার পূর্ণরূপ নিয়ে। বাড়ির পাশের পার্কের গাছে নতুন চকচকে পাতারা, চারদিকে করবী, পলাশ, ফুরুশ, আমের মঞ্জরী সব কিছু ঘোষণা করে তার আগমন। মেট্রো স্টেশনে উঠলে দেখি, শিমুল শিরীষ গাছের মাথায় রক্তরঙের বাহার। কি সুন্দর! আর তার সাথে গায়ে লাগে মৃদু ঠান্ডা দখিন হাওয়ার পরশ। গতকাল জানলা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি লালরঙের প্রকান্ড সেই পূর্ণ চাঁদ। এই তো সেই রঙে, রূপে, রসের স্রোতে ভরা দোলের মায়া। বাংলা থেকে কতদূরে, তবুতো কাছে, আমার চোখের পাশে। এইতো আমার বসন্ত। এরই জন্য তো আমার গাইতে হবে, "ওরে আয়রে তবে মাতরে সবে আনন্দে।" সকলে তাতে যোগ দেবে তো?
দোল খেলা ২০১৮

Comments

Popular posts from this blog

শকুন্তলা: রূপ থেকে রূপান্তরে

দিল্লীর প্রবাস জীবনে রবীন্দ্রনাথ

Bengali narrative: What are we known for?